শেখ সেলিমের আশির্বাদপুষ্ট
গণপূর্তের প্রভাবশালী প্রকৌশলী ফারুক চৌধুরী
বৈষম্য বিরোধী সফল আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে দেশ সংস্কারের জন্য। দেশের সংস্কারে প্রয়োজন প্রতিটি স্তর, সরকারি সকল অধিদপ্তর থেকে আওয়ামীপন্থীদের নির্মূল করা। বিশেষ করে সংস্কার প্রয়োজন গণপূর্ত অধিদপ্তরে। ঢাকায় জেঁকে বসা প্রভাবশালী প্রকৌশলীদের বাধ্য হয়েই ঢাকার বাইরে বদলি করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব প্রভাবশালী প্রকৌশলীরা ঢাকার বাইরে বদলি নিচ্ছেন এই শর্তে যে ছয় থেকে আট মাস পরেই তাদেরকে আবার ঢাকায় বদলি করে নিয়ে আসতে হবে। এমনই এক প্রভাবশালী প্রকৌশলী মো. শাহ্ আলম ফারুক চৌধুরী। টানা ছয় বছর ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এই সময়কালে তিনি আওয়ামী সরকারের সাথে যোগসাজশে কোটি টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রকৌশলী শাহ আলম ফারুক চৌধুরী ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী পদে বদলি হয়ে আসেন। সাবেক ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভাই শেখ সেলিমের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। সেলিমের প্রভাবেই তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন। তার দপ্তরের পূর্ত কাজ দেওয়ার জন্য ঠিকাদার বাছাই করে বড় কমিশনের বিনিময়ে কাজ ভাগ বন্টন করতেন। শেখ সেলিমের প্রভাবেই তিনি গণপূর্ত বিভাগ-২ এ নিয়ম বহির্ভূতভাবে দীর্ঘ ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা সরকারের এক দপ্তরে সর্বোচ্চ তিন বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। কিন্তু তার কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাওয়া ও আওয়ামী প্রভাবের কারণেই সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে তাকে এই ছয় বছর বদলি করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়াও গণপূর্তে প্রধান প্রকৌশলীর সার্কুলার/নির্দেশনায় এলটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহবান করার নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ৯০ শতাংশ দরপত্র ওটিএম পদ্ধতিতে আহবান করেছেন ফারুক। জানা যায়, ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহবান করলে নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজটি দিতে পারেন নির্বাহী প্রকৌশলীরা। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্যই ২০ শতাংশ কমিশন নিয়ে ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহবান করতেন তিনি।
এদিকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিটি স্তরেই সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। মহানগর দক্ষিনের যুবলীগ নেতা তাজবিরুল ইসলাম অনুর সাথেও তার বিশেষ সখ্যতা ছিল। তার দপ্তর থেকে তাজবিরুল ইসলাম অনু যেসকল ঠিকাদারি কাজ নিয়েছিল তার বেশিরভাগ কাজই ফারুক ও অনু মিলে নিজেরদের সুবিধা অনুযায়ী প্রাক্কলন তৈরি করেছিলেন। এতে অনু কাজগুলোর কিছু করে কছু না করেই সম্পূর্ণ বিল শাহ্ আলম ফারুক চৌধুরীকে মোটা অংকের কমিশন দিয়ে তুলে নিয়েছেন।
গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এরকম কাজ না করেই বিল দিয়েছেন প্রায় দশ কোটি টাকার। এই টাকার দরপত্র আহবান করার দুই দিনের মধ্যেই কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে কমিশনের বিনিময়ে বিল পরিশোধ করেছেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক ঠিকাদার জানান, গণপূর্তের বেশিরভাগ পূর্ত কাজ সংস্কার বা মেরামতেরই হয়ে থাকে। কিন্তু নির্মাণ বা মেরামত কোনো কাজই দরপত্র আহবানের দুই দিনের মধ্যে সমাপ্ত করা অসম্ভব। কমিশন নিয়েই ফারুক বিলগুলো দিয়েছেন। কাজগুলো যাচাই করলে দেখা যাবে কোনো কাজই হয়নি।
গণপূর্ত অধিদপ্তরে কাগজ কলমে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কাজ দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা রীতিমত প্রতিষ্ঠিত। প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে নির্বাহী প্রকৌশলী সকলেই এই কাজ করে টাকা আত্মসাৎ করেন। নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহ্ আলম ফারুক চৌধুরী-এর বিরুদ্ধেও এইভাবে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। তিনি পিয়ারু সর্দারের সাথে যোগসাজশে গণভবন ও ধানমন্ডি ৩২-এ ১২ মাসের এর রেকর্ড ভঙ্গ করে প্যান্ডেল ও সাজসজ্জার নামে ভৌতিক বিল পরিশোধ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই বিল নিজের মধ্যে অর্ধেক করে ভাগাভাগি করেছেন তিনি।
শাহ আলম ফারুক চৌধুরী গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগ-২ এ বদলি হয়ে এসে ক্ষমতার প্রভাবে ঢাকায় জেঁকে বসেছিলেন। ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগের কারণে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখে তাকে বাগেরহাট গণপূর্ত বিভাগে বদলি করা হয়। কিন্তু সেখানে তিনি সপ্তাহে এক থেকে দুই দিনের বেশি অফিস করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী সরকারের পতনের পর তার ক্ষমতা কিছুটা কমে আসায় এখন তিনি ঢাকায় বদলি হয়ে আসতে ঢাকার প্রধান কার্যালয় ও মন্ত্রণালয়ে তদবিরেই ব্যস্ত থাকেন বলেও জানা যায়।
সার্বিক বিষয়ে মো. শাহ্ আলম ফারুক চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক আজকের সংবাদকে বলেন, আমি শেখ সেলিমকে চিনিই না তিনি কে। ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহবান করার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আর কাজ না করে কোথাও বিল দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। কাজগুলো হয়েছে গণবভবনে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে কাজ না করে বিল দেওয়া কি সম্ভব?
দরপত্র দুই দিনের মধ্যে সমাপ্তের বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন ভিআইপি জায়গায় অগ্রীম কিছু কাজ করতেই হয়। এরকম কিছু কাজ করা ছিল পরে শুধু প্রক্রিয়া পালন করা হয়েছে। এজন্যই দুই দিনে বিল দেওয়া হয়েছে। আর গণভবনে প্রোগ্রাম হয়েছে সেটা সবাই দেখেছে। এখানে ভৌতিক বিল দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না।