পেনশনের ছাড়পত্র দেন প্রধান প্রকৌশলী
গণপূর্তে রাজস্ব ক্ষতি ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি

দেশের উন্নয়নের কাজের অগ্রপথিক হিসেবেই গণপূর্ত অধিদপ্তরের উত্থান। অথচ উন্নয়নের বদলে অনিয়ম, দুর্নীতি আর সরকারের আর্থিক ক্ষতির অগ্রপথিক হিসেবেই এগিয়ে যাচ্ছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের প্রতিটি বিভাগ থেকে নিত্য-নতুন উপায়ে অর্থ আত্মসাৎ করে যাচ্ছে অধিদপ্তরের প্রায় প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, আত্মসাতের চিত্র উঠে আসছে পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের প্রতি অর্থ বছরের অডিট রিপোর্টে। পূর্ত অডিট অধিদপ্তর সুপারিশও করছে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। তারপরও অভিযুক্ত কারো বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বরং অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থ আত্মসাৎ করে একেক বছরের অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর। কেউ কেউ এর মধ্যে অবসরেও চলে গেছেন। অবসরে গিয়েও অনিয়মের মধ্য দিয়ে পূর্ণ পেনশনের সুবিধা পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টদের সহায়তায়।
এরকম চিত্রই দেখা যায় আজকের সংবাদের অনুসন্ধানে। অধিদপ্তরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় আট হাজার অডিট আপত্তি অনিষ্পণ্ন অবস্থায় রয়েছে।
২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৮ এর নির্বাহী প্রকৌশলীর স্বাক্ষরিত ই/এম-৮/৬৪০/৮(৬) স্মারকে অনিষ্পণ্ন আপত্তির বাস্তবতা সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে জানান, এসব অনিষ্পণ্ন অডিট আপত্তির প্রেক্ষিতে গণপূর্ত অধিদপ্তরেই সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরই কয়েক হাজার কোটি টাকার অনিয়ম থাকে গণপূর্ত অধিদপ্তরে। সেই হিসেবে ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছর পর্যন্ত অডিট আপত্তি প্রায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এসব অডিট নিষ্পত্তির লক্ষ্যে পূর্ত অডিট অধিদপ্তর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে কিছু সুপারিশও করে। কিছু ক্ষেত্রে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা নির্দিষ্টভাবে সুপারিশ করা হয়। তারপরও কোন সুরহা হয় না। কোন এক অদৃশ্য কারণে অডিট আপত্তিগুলোর নিষ্পত্তি আলোর মুখ দেখে না। আপত্তির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কোন প্রকার শাস্তিও হয় না। যে কারণে এসব অনিয়ম বন্ধের বদলে আরো বেড়ে যায়। অনিয়ম-দুর্নীতি করে পার পেয়ে তারা আরো বড় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরে। এজন্যই আগের চেয়ে বর্তমানে অডিট আপত্তিতে জড়িত টাকার পরিমাণ অনেক বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা আজকের সংবাদকে জানান, অনিষ্পণ্ন অডিট আপত্তিগুলো জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকের তোলা হয়। সেই বৈঠকের আগেরদিন অডিট কর্তৃপক্ষ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সাথে অডিট আপত্তিগুলো নিয়ে দেখা করেন ও তাদের সুপারিশগুলো জানান। কিন্তু সেই সুপারিশগুলোর পরিবর্তে বেশিরভাগ অডিট আপত্তিই আর্থিক জরিমানার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। আর্থিক জরিমানায় আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য যেসব গণপূর্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আপত্তি থাকে তারা সকলেই জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সাথে আগেই তদবির করার জন্য তৎপর থাকেন বলেও জানা গেছে। জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও তা প্রতিপালন করা হয় না। এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের গণপূর্ত মনিটরিং ও অডিট সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাঈদ মাহবুব মোরশেদ আজকের সংবাদকে বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অডিট আপত্তি উঠলে সেগুলোর জবাব দেওয়া হয়। সেগুলোতে সন্তুষ্ট না হলে আবার আপত্তি আসে। আবার আমরা জবাব দিই। ২০ থেকে ৩০ বছর আগেরও কিছু অডিট আপত্তির এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এখন পর্যন্ত অডিট আপত্তিতে জড়িতদের কোন বিভাগীয় শাস্তিও হয়নি বলে আমার যতোটা মনে পড়ে।
এদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা আজকের সংবাদকে জানান, অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না করেই অবসরে চলে যাচ্ছে অধিদপ্তরের অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। তারা সরকারি পূর্ণ পেনশন ভাতাও নিচ্ছেন। কিভাবে এতো সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন তা সকলের অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। পেনশন সহজীকরণ আইন ২০০৯ এর ধারা ২.১২ অনুসারে কোন কর্মচারী বা কর্মকর্তার নামে অডিট আপত্তি থাকলেও মোট আনুতোষিকের ৮০ শতাংশ অর্থ পেনশন হিসাব মঞ্জুর করা যাবে। কিন্তু এখানে তারা পূর্ণ পেনশনের সুবিধাই নিচ্ছেন।
পেনশন পাওয়ার বিষয়ে পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা আজকের সংবাদকে বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা পরিদপ্তর থেকে অনাপত্তি সনদ নিয়ে পূর্ণ পেনশন তোলেন। এখানে আমাদের অডিট আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে অনাপত্তি সনদ দিয়ে এসেছে। আর এইজন্যই পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের গুরুত্ব গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে কম ছিল। কিন্তু এখন থেকে সেটা আর হবে না। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি একটি আদেশ দিয়েছে যাতে লেখা রয়েছে, পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের অনাপত্তি সনদ ছাড়া কোন কর্মকর্তাই পূর্ণ পেনশন পাবেন না। এবং এই আদেশ এখন কার্যকর।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা পরিদপ্তর পরিচালক এস এম নিয়ামুল পারভেজ আজকের সংবাদকে বলেন, আসলে পেনশনের জন্য অনাপত্তি ছাড়পত্র দেওয়া আমাদের কাজ না। মন্ত্রণালয় চাইলে আমরা কাগজপত্র দেখে শুধু অডিট আপত্তি আছে কিনা তা সরবরাহ করি।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (অডিট অনুবিভাগ) শাহনাজ সামাদ আজকের সংবাদকে বলেন, ‘কাগজপত্র না দেখে কিছুই বলা যাবে না। আর গণপূর্ত অধিদপ্তরই পনশনে যাবার অনাপত্তি ছাড়পত্র দেয়। এগুলো গণপূর্ত অধিদপ্তরেই সংরক্ষিত থাকে। আর কোনো অনাপত্তি সনদ দেওয়া হয় না। শুধু চিঠি দেওয়া হয়, তাতে লেখা থাকে তার বিরুদ্ধে কোন অডিট আপত্তি নাই। ভবিষ্যতে আপত্তি আসলে সেটার দায়ভার তাকেই নিতে হবে।’ পূর্ত অডিট অধিদপ্তরকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আমলে নেন না তা ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুজ্জামান চুন্নুর কথাতেই বোঝা যায়। তিনি বেশ দম্ভ করেই আজকের সংবাদকে বলেন, তিনি একাত্তরের পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৪ এর সকল অডিট আপত্তির জবাব দিয়েছেন। এটা আগে কেউ করেননি। সাইফুজ্জামান চুন্নু আরো বলেন, কোন অধিদপ্তরের অডিট আপত্তি নেই? কাজ করতে গেলে আপত্তি আসবেই। আর অডিটের কাজই হল সব ঠিকঠাক কাজের মধ্যে অযথা অনিয়ম বের করা।
অডিট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির আদেশের পরেও এখন পর্যন্ত ক্যাডার কোন কর্মকর্তা পূর্ত অডিট অধিদপ্তর থেকে অনাপত্তি সনদ নিতে যাননি। যারা অনাপত্তি সনদ নিতে গিয়েছেন তাদের সকলেই নন-ক্যাডার। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, গণপূর্ত অধিদপ্তরের বেশির ভাগ অনাপত্তি সনদ প্রদান করেন প্রধান প্রকৌশলী নিজেই। আর বর্তমানে অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আকতার। এদিকে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধেই রয়েছে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ। তার কিছু দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। তিনি নিজেকে পীর হিসেবে দাবি করেন এবং সেই মোতাবেক তিনি অধিদপ্তরের বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তার মুরিদ বানিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। যেই সিন্ডিকেট গণপূর্ত অধিদপ্তরের নানা দুর্নীতির সাথে জড়িত।
এই বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আকতারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। পরে তার মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তায় বক্তব্য চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি প্রতিউত্তর দেননি।