মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্পে চলছে হরিলুট

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

বিশেষ প্রতিনিধি
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৫ ১৮:৫৪:২৬

স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)-এর ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকার "মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্প"-এর পরতে পরতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. তবিবুর রহমান তালুকদার এর সাথে যোগসাজশে নির্বাহী প্রকৌশলীরা এই দুর্নীতি করছেন বলে জানা যায়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাস এই দুর্নীতির দৌড়ে এগিয়ে আছেন বলেও জানা যায়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও প্রকল্পের কাজে ফাঁকি ও অনিয়মের মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

জানা যায়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পলাশ চন্দ্র দাস ২০২২ সালের আগষ্ট মাসে যোগদান করেন। ওবায়দুল কাদেরের সরাসরি সুপারিশে তিনি তার থেকে অভিজ্ঞ ও সিনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলীদের পেছনে ফেলে দেশের অন্যতম গুরুত্তপূর্ণ স্থান চট্টগ্রাম জেলার দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন নামে বেনামে নিজেই ঠিকাদারী কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প, পিইডিপি ৪ প্রকল্প, মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্প, ৩০ ও ৩২ পৌরসভা প্রকল্প সহ অন্যান্য সরকারী কাজে তার বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ২০২৫ সালের আগস্ট মাসের ২৫ তারিখে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার জনৈক আব্দুস সাত্তার প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ সহ চাঞ্চল্যকর অভিযোগ দায়ের করেন বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে।

চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলার মধ্যে বাঁশখালী উপজেলা সব থেকে অনগ্রসর ও অবহেলিত। আব্দুস সাত্তারের দাবী করেন ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে “মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ প্রকল্প”থেকে বাঁশখালী উপজেলার ১৪ টি ইউনিয়নের জন্য অতিরিক্ত ১৫০টি করে মোট ২১০০টি ল্যাট্রিনের বরাদ্দ আসে। ল্যাট্রিনগুলি হতদরিদ্রদের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে প্রদান করা হয়ে থাকে। বরাদ্দ আসার পরও দীর্ঘদিন কাজ না হওয়াতে, ২০২৫ সালের আগষ্ট মাসে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালকের অফিস থেকে খবর পান, বাঁশখালী ইউনিয়নের অতিরিক্ত বরাদ্দের ২১০০টি ল্যাট্রিন থেকে চন্দনাইশ ইউনিয়নে ৬০০ টি ল্যাট্রিন স্থানান্তর করা হয়েছে। ২০২৫ সালের জুনের ০১ তারিখে চন্দনাইশ ইউনিয়নের ৬০০টি ল্যাট্রিন তৈরীর কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে। কার্যাদেশ প্রদানের পর ল্যাট্রিনের উপকারভোগীর তালিকা তৈরীর পূর্বে ২৪ দিনের মাথায় ৪০০টি ল্যাট্রিন তৈরী সম্পন্ন দেখিয়ে বিল প্রদান করে। এই বিলের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে গোপনে তারা এই অনিয়ম করে বলে আব্দুস সাত্তার জানান।

এছাড়া 'মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ প্রকল্প' এর মাধ্যমে হতদরিদ্র পরিবারের জন্য ল্যাট্রিন তৈরীর কার্যাদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে মারাত্মক অনিয়মের অভিযোগ এসেছে নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশের বিরুদ্ধে। প্রকল্পের জেলা ভিত্তিক স্থানীয় উদ্যোক্তা নিয়োগের জন্য বরাদ্দ ৭৭২ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা যা প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ৪১.০৫ শতাংশ। ই-জিপি টেন্ডারের বাইরে গিয়ে এই ৭৭২ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার টাকার টেন্ডারের অনুমোদন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও মন্ত্রণালয় দিয়েছে শুধুমাত্র স্থানীয় উদ্যক্তাদেরকে মানসম্পন্ন ল্যাট্রিন তৈরীর জন্য উৎসাহ ও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য। তার বদলে পলাশ চন্দ্র দাস প্রকল্প প্রণয়িত বিধিমালা ও ডিপিপির বাইরে গিয়ে তার আত্মীয় ও প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারদেরকে কাজ দেওয়ার ফলে চট্টগ্রাম জেলার স্থানীয় উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিধি বহির্ভূতভাবে পলাশ চন্দ্র নিজের লোক দিয়ে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ আর্থিক সুবিধা নেওয়ার উদ্দেশ্যে তার আত্মীয় 'নকুল চন্দ্র দাস ও যুধিষ্ঠির কুমার দাস, উভয়ের পিতা- করুনা কুমার দাস, সাং- উত্তমপুর লামছি, কবিরহাট, নোয়াখালী'-কে, বাঁশখালী উপজেলার পূর্ব চাম্বল সাকিনের অধিবাসী দেখিয়ে 'আরণ্যক ট্রেডিং' ও 'কুল ট্রেডার্স' নামীয় প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স তৈরী করেছেন। উক্ত ভূয়া ঠিকানার ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ১৩ কোটি ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৪৪ টাকা মূল্যের ৩৮৯৩টি 'টুইন পিট ল্যাট্রিন' বাঁশখালী, পটিয়া ও মিরসরাই উপজেলায় মোট ৫টি কার্যাদেশ প্রদান করেছে।

আরো, মেসার্স বি এল কর্পোরেশন এর প্রোপাইটার মোহাম্মদ বোখারী আজম এর পিতা মরহুম জালাল আহমেদ চৌধুরী এর ঠিকানা রেয়াজুদ্দীন বাজার, কোতয়ালী, চট্টগ্রাম এবং জন্মস্থান কক্সবাজার। সে চন্দনাইশের কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের স্থানীয় উদ্যোক্তা পরিচয়ে দুইটি আলাদা কার্যাদেশ পেয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার 'টুইন পিট ল্যাট্রিন' নির্মাণের কার্যাদেশ প্রাপ্ত অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। বিপুল পরিমাণ অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে এদেরকে কাজ দেওয়ার ফলে কাজের গুণগত মান খারাপ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এবিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পলাশ চন্দ্র দাসের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনে এই প্রতিবেদকের পরিচয় জেনেই বলেন, 'আপনার কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না'। তখন তাকে তার নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি আছেন বলেন। পরে তাকে হোয়াটসঅ্যাপ ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো প্রতিউত্তর দেননি।