অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন
ধামাচাপা দিতে মরিয়া প্রিমিয়ার ব্যাংক!!

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লাক মিয়া আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় কয়েকটি হিসাব থেকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করেছেন বলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই লেনদেনগুলো অস্বাভাবিক লেনদেন হিসেবে দেখলেও এই ধরনের কোনো লেনদেনই হয়নি বলে ব্যাংকটির কিছু দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দাবি করে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রিমিয়ার ব্যাংকটির অন্তত ১০ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কোন আইনের তোয়াক্কা না করেই এই লেনদেনে জড়িয়েছেন। তাদের আইনের হাত থেকে রক্ষায় এখন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এমনকি ব্যাংকটির জনসংযোগও বিভাগের নীরবতাও বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরি করছে।
অভিযোগ আছে, লাক মিয়া, তার স্ত্রী এবং তাদের এক কর্মচারীর কয়েকটি ব্যাংকে যে হিসাবগুলো খুলে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে যে লেনদেনগুলো করেছেন তার পরিমান কয়েক হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো বলছে লেনদেনে তারা কোন আইনই ভাঙেননি। এমনই এক ব্যাংকের নাম বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসি। যদিও তারা এই বিষয়ে নিজেদের কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য জানাতে পারেননি।
আলোচনা আছে, ব্যাংকটির কিছু ঊর্ধতন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই প্রিমিয়ার ব্যাংকের কোনাবাড়ি, বনানী, মতিঝিল শাখায় হাজার কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের ঘটনাগুলো ঘটেছে। যদিও বারবারও অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মনে করছেন ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। কারন তাদের কাছে রয়েছে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ। তবে বারবার বিষয়টি ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের নজরে আনলেও তারা নীরব কেনো এই প্রশ্নও উঠছে এখন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এদের আইনের আওতায় আনা গেলে বেরিয়ে আসবে অনেক বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতির তথ্য।
তদন্তে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লাক মিয়া ছাড়াও তার স্ত্রী মোসাম্মত মাহমুদা বেগমের বিরুদ্ধে রয়েছে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা। অভিযোগ আছে এই দম্পত্তির অন্তত ২০ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। চেয়ারম্যান থাকাকালে মাহমুদার ১৪টি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট থেকে মোট ৪৬১ কোটি ১৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এরমধ্যে ২০০৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ২৩০ কোটি ৬৯ টাকা জমা এবং ২৩০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। অন্যদিকে তাদের প্রতিষ্ঠানের ১২ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী মো.মহসিন মোল্লার অন্তত ১৪টি ব্যাংক হিসাবে ১০ হাজার ৩২২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার লেনদেন করা হয়েছে।
দুদকের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ি লাক মিয়া, তার স্ত্রী ও তাদের কর্মচারীর পৃথক মালিকানাধীন এম/এস সালমা ট্রেডার্স, ভাই ভাই স্পিনিং মিলস ও এনআরবি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড এবং এম/এস এনআরবি ট্রেডার্সের নামে খোলা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেবল মাত্র প্রিমিয়ার ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে গত ৫ অগাষ্টের পর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এই অর্থের উৎস নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে ঠিক তেমনি এই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে কোথায় ব্যবহার করা হলো সেটি নিয়েও রয়েছে বিস্তর আলোচনা।
সূত্র জানায়, প্রিমিয়ার ব্যাংকে লাক মিয়ার লেনদেনের তথ্য থেকে জানা গেছে সেখানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই ব্যাংকটির মতিঝিল, বনানী ও কালিবাড়ি শাখা থেকে বিপুল পরিমান অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। যার মধ্যে কালিবাড়ি শাখা হতে এম/এস সালমা ট্রেডার্সের নামে ১২০৫ কোটি ৮৮ লাখ ৮৩ হাজার ৪৪৭ টাকা, ওই একই শাখা থেকে লাক মিয়ার নামে ১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ৯৫৪ টাকা, ভাই ভাই স্পিনিং মিলসের নামে ২৫৫ কোটি, ৩৭ হাজার ৮৯৭ টাকা, এম/এস সালমা ট্রেডার্সের নামে ৭৮০ কোটি ৯৮ লক্ষ ২১ হাজার টাকা ও এম/এস সালমা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ২৬৯ কোটি ১৬ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
পাশপাশি বনানী শাখা হতে ভাই ভাই স্পিনিং মিলসের নামে ৭৫ কোটি ৮০ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ টাকা এবং ২৩৩ কোটি ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ৫শ টাকা ও এম/এস সালমা ট্রেডার্সের নামে ৫ কোটি ৫৬ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮১৩ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। অন্যদিকে মতিঝিল শাখায় এম/এস সালমা ট্রেডার্সের নামে পৃথকভাবে ২৯২ কোটি ১৩ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা ও ১২৩ কোটি ২ লক্ষ ৬৪ হাজার ৭৯১ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। লাক মিয়ার এই সব লেনদেনের যোগফল দাঁড়ায় ৩২৫ কোটি ৪৬ লক্ষ ৬২ হাজার ৮৪৩ টাকা।
অন্যদিকে লাক মিয়ার স্ত্রী মোসাম্মত মাহমুদা বেগমের লেনদেনের তথ্য হতে জানা গেছে, তার প্রিমিয়ার ব্যাংকের কালিবাড়ি শাখায় এমএস বিআরবি ট্রেডার্সের নামে ৭৯ কোটি ৬৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা জমা ছিল। পরে ৭৯ কোটি ৬৪ লাখ ৬৯ হাজার ১৮৯ টাকা তুলে নেওয়া হয়। ওই এ্যাকাউন্টে এখন ৫৪ হাজার ৮১১ টাকা রয়েছে। পাশপাশি তাদের কর্মচারী মো.মহসিন মোল্লার ব্যাংকিং লেনদেন হতে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রিমিয়ার ব্যাংক কালিবাড়ি শাখা হতে এনআরবি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের নামে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ৫১ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা, একই শাখায় এম/এস এনআরবি ট্রেডার্সের নামে ৪২ কোটি৩৫ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা, ওই শাখায়ই এম/এস এনায়েত ট্রেডার্সের নামে ৮ কোটি ৮৬ লক্ষ ৬২ হাজার ৭৫৭ টাকা, এম/এস এনআরবি ট্রেডার্সের নামে ৮৭৬ কোটি ৭ লক্ষ, ৯১ হাজার টাকা, মো.মহসিন মোল্লার নিজ নামে আলাদাভাবে ৫০ লক্ষ টাকা ও ২ কোটি ৯৯ লক্ষ ৭৩ হাজার টাকা, এম/এস এনআরবি ট্রেডার্সের নামে ৮৪ কোটি ৭৯ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা উত্তালন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রিমিয়ার ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় এম/এস এনআরবি ট্রেডার্সের নামে ১৫৪ কোটি ৮৪ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। যার সর্বমোট হিসাব দাঁড়ায় ২ হাজার ৫২৮ কোটি ৯৬ লক্ষ ৭৬৫ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাক মিয়া পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় সপ্তাহখানেক আগেই। ভূমিদস্যুতাসহ নানা ধরনের অভিযোগ থাকা এই আওয়ামী লীগ নেতাসহ তার স্ত্রী মোসাম্মত মাহমুদা বেগম ও তাদের বেতনভুক্ত কর্মচারী মো.মহসিন মোল্লার বিরুদ্ধেও রয়েছে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। ওই এলাকার প্রভাবশালী সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর সরাসরি হাত ধরেই আওয়ামী লীগ নেতা বনে চেয়ারম্যান হয়ে যান লাক মিয়া। এলাকার অধিকাংশ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে উঠে আসতে থাকে তার নাম। দলীয় প্রভাব খাটিয়েই বিপুল অর্থ উপার্জন করে তা এরই মধ্যে বিদেশে পাচার করেছেন বলেও রয়েছে অভিযোগ।
পুলিশ জানায়, চেয়ারম্যান লাকমিয়ার বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতাসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাক মিয়া চেয়ারম্যান হওয়ার আগেই এলাকার শত শত নিরীহ মানুষের শত শত বিঘা সম্পত্তি জবরদখল করে ভাই ভাই স্পেলিং মিল সহ বেশ কিছু মিল ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেছে। এ সমস্ত জবরদখল করা জায়গা জমি নিয়ে অনেক নিরীহ মানুষ মামলা হামলার শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। পরবর্তীতে লাক মিয়া আওয়ামী লীগের এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর একচ্ছত্র হস্তক্ষেপে বিনা ভোটে পরপর তিনবার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর তিনি নীরিহ এলাকাবাসীর উপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন। জবরদখল করতে থাকেন আরো নিরীহ মানুষের জায়গা সম্পত্তি। এই ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা চলমান রয়েছে। তাছাড়া একটি মামলায় তার মালামাল ক্রোকেরও নির্দেশনা রয়েছে।
এছাড়াও এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাক মিয়ার স্ত্রী মোসাম্মত মাহমুদা বেগম ও তাদের কর্মচারী মো.মহসিন মোল্লার কোনো সন্ধান দিতে পারছেন না এলাকাবাসী ও তাদের স্বজরা। ধারনা করা হচ্ছে লাক মিয়া গ্রেপ্তারের পর তারা পলাতক রয়েছেন।
প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসি একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক যার নিবন্ধিত অফিস ঢাকার বনানীতে অবস্থিত। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এইচবিএম ইকবাল এ বছরের ১২ জানুযারি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ইমরান ইকবালকে নতুন চেয়ারম্যান করা হয়েছে। মোহাম্মদ আবু জাফর ২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের জনসংযোগ শাখায় সপ্তাহখানেক আগে যোগাযোগ করলে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ওই বিভাগের কর্মকর্তা জনাব তারেক জানান, ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকে তারা বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন। তবে পরবর্তীতে এই বিষয়ে ব্যাংকটির অবস্থান তুলে ধরে তাদের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি তিনি।
তবে একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই বিষয়ে ব্যাংকটির কিছু বিতর্কিত কর্মকর্তার মতো জনাব তারেকেরও রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত ভূমিকা। তিনি এই বিষয়ে দায়িত্বশীলদের থেকে বক্তব্য পেয়েও গণমাধ্যমকে না জানিয়ে মূলত ব্যাংকটির ইমেজ সংকটের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছেন। যা তার থেকে কেউ আশা করে না।