সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ

মো হাবিবুর রহমান
মো হাবিবুর রহমান
প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৫ ১৯:৪৯:৫৫  আপডেট :  জুলাই ২৭, ২০২৫ ১৯:৫৬:৩৬

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন শুধু একটি বনাঞ্চল নয়, এটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি প্রাকৃতিক অস্তিত্ব। এটি একাধারে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে, বিপন্ন প্রজাতির আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে, আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে কোটি কোটি মানুষের জীবন ও সম্পদ।

সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থিত। এই বিস্ময়কর বনাঞ্চল ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বনের অভ্যন্তরে থাকা অসংখ্য নদী, খাল ও জলাশয় এটিকে একটি জটিল ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে।

বাংলাদেশ প্রতিবছর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়। বিশেষত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সুন্দরবন একটি প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে এসব দুর্যোগের তীব্রতা কমিয়ে আনে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের আইলা, এবং সাম্প্রতিক ২০২৩ সালের মোখা সুন্দরবনের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। এসব ঘূর্ণিঝড়ে বহু গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, বনের গঠনগত অবস্থান এবং ঘনত্ব উপকূলের জনবসতিকে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচিয়েছে।

পরিবেশবিদদের মতে, সুন্দরবনের গাছপালা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কমাতে সাহায্য করে এবং বায়ুর গতি শ্লথ করে, যার ফলে ঝড়ের প্রভাব অনেকটাই প্রশমিত হয়। তাই সুন্দরবনকে অনেকেই 'প্রাকৃতিক ব্রেকওয়াল' বা ঢাল বলে অভিহিত করেন।

সুন্দরবন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত। এছাড়াও এখানে রয়েছে চিত্রা হরিণ, গাঙ্গেয় ডলফিন, মিঠা পানির কুমির, নানা জাতের পাখি ও কীটপতঙ্গ। বর্তমানে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। পরিবেশগত বিপর্যয়, অবৈধ শিকার এবং প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংসের কারণে বহু প্রজাতি হুমকির মুখে। বনে রয়েছে ৩৩৪টিরও বেশি উদ্ভিদ প্রজাতি, ৩৭৫টির মতো বন্যপ্রাণী এবং প্রায় ২৭০ প্রজাতির পাখি। এসব প্রাণী ও উদ্ভিদ সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করছে।

সুন্দরবন শুধু প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বনজ সম্পদ, মধু সংগ্রহ, মাছ ও কাঁকড়া আহরণ, নৌ-পর্যটনসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে লক্ষাধিক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এছাড়া সুন্দরবন প্রচুর পরিমাণে কার্বন শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে সাহায্য করছে। এটি বাংলাদেশের জলবায়ু ভারসাম্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

হুমকি ও চ্যালেঞ্জ

দুঃখজনকভাবে, সুন্দরবন বর্তমানে নানা হুমকির মুখে। বন উজাড়, চোরাকারবারি, অযাচিত শিল্পায়ন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং অপরিকল্পিত পর্যটনের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, লবণাক্ততা বাড়ছে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছেন যে, এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।

সুন্দরবন রক্ষায় সরকার, পরিবেশবাদী সংস্থা ও সাধারণ জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে। বন সংরক্ষণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ, বনাঞ্চলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটনের উন্নয়ন সুন্দরবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণ। এটি শুধু গাছপালার বন নয়, এটি একটি প্রাকৃতিক জীবনবিন্দু, যা দেশের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুন্দরবন বাঁচলে আমরা বাঁচব-এই বিশ্বাস নিয়ে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্বে।