কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: বাংলার মাঠে-ঘাটে অনিশ্চয়তার ছায়া

মো আশরাফুল ইসলাম
মো আশরাফুল ইসলাম
প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০২৫ ১৮:১৬:২২

বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি হলো কৃষি। এই কৃষির ওপরই নির্ভর করে দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি আজ এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, তীব্র খরা, অতিবৃষ্টি ও আকস্মিক বন্যার মতো ঘটনা কৃষিকে করে তুলেছে ক্রমশ অনির্ভরযোগ্য। এই পরিবর্তন শুধু কৃষকের ক্ষেতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং অর্থনীতিকেও গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে।

ঋতুর পরিবর্তনে বিভ্রান্ত কৃষিজ পরিকল্পনা

এক সময় বাংলাদেশে ছয় ঋতুর স্পষ্ট উপস্থিতি থাকলেও এখন তা প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। বসন্ত যেন হারিয়ে গেছে, বর্ষা আসে বিলম্বে অথবা মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত নিয়ে, শীত আসে হঠাৎ করে আবার দ্রুত বিদায় নেয়। এই ঋতুবৈচিত্র্যের বিশৃঙ্খলা কৃষকদের চাষাবাদের সময় নির্ধারণে সমস্যায় ফেলছে। ফলশ্রুতিতে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

জলবায়ুর দাপটে কৃষি উৎপাদনে ধস

গ্রীষ্মে অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ এবং বর্ষায় অপ্রত্যাশিত ভারী বৃষ্টিপাত-এই দুই চরম আবহাওয়া ফসলের জন্য মারাত্মক হুমকি। উদাহরণস্বরূপ, আমন ধানের চারা যখন জমিতে রোপণ করা হয়, তখন যদি দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হয়, তবে তা মরে যায়। আবার বৃষ্টি বেশি হলে ক্ষেত জলমগ্ন হয়ে গাছ পচে যায়। একইভাবে, খরার কারণে অনেক স্থানে পাট, তিল ও গমের চাষ হুমকির মুখে পড়েছে।

মাটির গুণাগুণে পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক মারাত্মক প্রভাব পড়ছে মাটির ওপর। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বন্যার ফলে উর্বর মাটি ধুয়ে যাচ্ছে, আবার খরার সময় মাটি শক্ত ও ফেটে যাচ্ছে। এতে ফসলের শিকড় স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হতে পারে না। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সেই জমিতে আগের মতো ধান, সবজি বা তরমুজের চাষ আর সম্ভব হচ্ছে না।

নতুন নতুন রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব

আবহাওয়ার উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি নতুন নতুন রোগ-বালাই ও পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাওয়া, ডগা শুকিয়ে যাওয়া, অঙ্কুর নষ্ট হওয়া বা ফলন কমে যাওয়া এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কৃষক এ সমস্যার সমাধানে কীটনাশক ব্যবহার করলেও এতে মাটির স্বাভাবিক জীবাণু হ্রাস পাচ্ছে এবং পরিবেশদূষণ বাড়ছে।

কৃষকের অর্থনৈতিক ক্ষতি ও ঋণের বেড়াজাল

ফসল নষ্ট হওয়ায় কৃষকদের বারবার লোকসান গুনতে হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষকরা ধার করে সার, বীজ ও সেচ খরচ চালান। কিন্তু ফসল না হলে সেই ঋণ শোধ করা সম্ভব হয় না। এর ফলে তারা আবার ঋণের দায়ে পড়ে নতুন করে চাষ করতে বাধ্য হন। এই চক্র থেকে অনেক কৃষক বের হতে না পেরে কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন, যা ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

অভিযোজনের প্রচেষ্টা ও সম্ভাবনা

তবে এই দুর্যোগের মাঝেও কিছু আশার আলো রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লবণসহিষ্ণু ও খরারোধী ধান, গম ও ডালের জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। ভাসমান বাগান, ঢালু জমিতে বৃষ্টিনির্ভর চাষ, কিংবা সৌরচালিত সেচব্যবস্থাও কিছু এলাকায় সুফল দিচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে পানিতে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজিচাষ এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

করণীয় ও পথনির্দেশ

১. স্থানীয় অভিযোজন কৌশলকে গুরুত্ব দিতে হবে, যেমন মৌসুমি পরিবর্তনের সাথে মিল রেখে চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন।
২. জল সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশবান্ধব সেচ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষকদের প্রস্তুত করতে হবে এবং প্রাথমিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে মাঠপর্যায়ে।
৫. আর্থিক প্রণোদনা ও সহজশর্তে কৃষিঋণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে কৃষকরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ভুক্তভোগী হলো কৃষক। তাদের কষ্ট, সংগ্রাম ও পরিশ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের খাদ্যনির্ভরতা। তাই জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় পরিকল্পিত উদ্যোগ ও প্রযুক্তিনির্ভর অভিযোজন ছাড়া কৃষিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতায় আমাদের প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও জনগণকেন্দ্রিক পরিকল্পনা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নিরাপদ ও খাদ্যসমৃদ্ধ বাংলাদেশ পায়।