ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে ভাগাভাগি করেছে পিকে হালদার
আওয়ামী সরকারের সোনালী ব্যাংক- ঋণের নামে লুটপাট

আওয়ামী সরকারের প্রবাবশালী ব্যাক্তিরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ভূয়া কাগজপত্র দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করেনি। পরবর্তীতে আইনের ফাক-ফোকড় দেখিয়ে টাকা পরিশোধ না করলেও ঋণ খেলাপির তালিকায়ও তাদের নাম নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য না করে টাকা রোজগারের চেয়ে ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করেই বরং টাকা কামাই করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তাদের টার্গেট ছিলো বিশেষ করে সরকারি ব্যাংক। এবং সফলও হতে পেরেছে। টার্গেট করা সরকারি এসব ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংক অন্যতম। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওই সময়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকতা ও আওয়ামী লীগের প্রভাশালী ব্যাক্তিরা মিলে মিশে এসব টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বলে প্রমাণ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড এর প্রধান কার্যালয় পরিচালনা পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত পরিপালন না করে স্ট্রেস টেস্টিং এ রেড জোন এবং দুর্বল আর্থিক পারফরমেন্স থাকা সত্ত্বেও ফান্ড প্লেসমেন্ট ও কল লোন খাতে পিপলস লিজিং এন্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডকে বিনিয়োগ করেছে ৫৬ কোটি টাকা। প্রশান্ত কুমার হালদারের সাথে যোগসাযোশে এই অর্থ বিনিয়োগ করেছিল সোনালী ব্যাংক।
পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, পিপলস লিজিং এন্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড এর অনুকূলে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এর অনুমোদনে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের ৮ তারিখ থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত ৭টি এফডিআর এর মাধ্যমে ফান্ড প্লেসমেন্ট খাতে ৪০ কোটি টাকা এবং কল লোন খাতে ১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে পিপলস লিজিং এন্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড এর অপারেটিং প্রফিট সিস্টেমে ৩০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা লোকসানে ছিল। নেট প্রফিটের ক্ষেত্রেও লোকসানের মাত্রা ছিলো ৪৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা এবং শ্রেণিকৃত ঋণ ২৩.৭৬ শতাংশ হলেও ব্যাংকের স্বার্থ পরিপন্থী দুর্বল আর্থিক পারফরমেন্স সম্বলিত প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে ফান্ড প্লেসমেন্ট ও কল লোন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বিনিয়োগের সময় প্রতিষ্ঠানটির স্ট্রেস টেস্টিং এ রেড জোনভুক্ত ছিল। রেড জোনভুক্ত প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সোনালী ব্যাংক ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন থেকে পিপলস লিজিং এন্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড এর ফান্ড প্লেসমেন্ট এ ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ৩ তারিখের পত্র অনুযায়ী ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির ক্যামেলস রেটিং ৪ যা প্রান্তিক বলে বিবেচিত হয়। ফলে ক্যামেলস রেটিং অনুযায়ী বিভিন্ন আর্থিক প্যারামিটারে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পারফরমেন্স অসন্তোষজনক ও প্রান্তিক সুবিধার হওয়া সত্ত্বেও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এদিকে, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের ২৮ তারিখে সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৪৯৪ তম সভার সিদ্ধান্তের ক্রম (গ) অনুযায়ী আর্থিক প্রতিবেদন ও ক্রেডিট রেটিং (ঘ) অনুযায়ী আর্থিক বিবরণী এবং (ঙ) অনুযায়ী ক্যামেলস রেটিং বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরিচালনা পর্ষদের ওই সিদ্ধান্ত পরিপালন না করে দূর্বল আর্থিক পারফরমেন্স সম্বলিত ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে অর্থ ভাগাভাগি করে নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য বিনিয়োগ করা হয়েছে মূলত।
কেলেঙ্কারিতে দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের হাইকোর্ট থেকে নিয়োজিত চেয়ারম্যান হাসান শাহেদ ফেরদৌস আজকের সংবাদকে জানান, সোনালী ব্যাংকসহ ১১টি প্রতিষ্ঠান থেকে সেই সময় পিপলস লিজিং এন্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড লোন নিয়েছিল। ব্যাংকগুলো তার বিনিয়োগের নিরাপত্তা ঠিক মতো দেখেনি। দুর্বল একটি প্রতিষ্ঠানকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে ভালো অবস্থা দেখিয়ে লোন দিয়েছে ব্যাংক। কেলেঙ্কারির পরে উচ্চ আদালত থেকে আমাদের নিয়োগ দেওয়া হলে আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে উঠানোর চেষ্টা করছি। এখনো ব্যাংকের লোন দেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার মতো অবস্থা হয়নি। এখন পর্যন্ত ৭০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছি। ব্যাক্তিগত প্রায় আট থেকে নয়শত একাউন্টের সম্পূর্ণ পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে যারা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছিল। অনেক হিসাব নিকাশ থাকার কারণে আমরা এখন ব্যাংকের লোন ফেরত দিতে পারছি না।
অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের দুর্বল আর্থিক অবস্থা থাকা স্বত্ত্বেও তৎকালীন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা অমান্য করে এই লোনের অনুমোদন দেন। তাদের সাথে পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাতের অংশীদারিত্ব ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ট্রেজারী ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন থেকে জানানো হয় যে, আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় কিছু বলা যাচ্ছে না। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডকে অবসায়নে পাঠানোর আগেই এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করে পিকে হালদার ও তার সহযোগিরা।