বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদে নিয়োগ পেতে এস আলম ও সালমান এফ রহমানের দোসররা তদবীরে এগিয়ে
নজিরবিহীন লুটপাট, ঋণ কেলেঙ্কারি আর দখলদারিত্বের কারণে আজ দেশের ব্যাংকিং খাতের করুণ অবস্থা। এজন্য দায়ী করা হয় এস আলম, সালমান এফ রহমান ও তাদের দোসরদের। সেই গোষ্ঠীর সহযোগী ও ঘনিষ্ঠরা এখন ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) হওয়ার দৌড়ে আছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ডিজি পদ পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেসব নির্বাহী কর্মকর্তাদের নামের তালিকা আছে তাদের মধ্যে তিনজনই সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ঠ। তারা সরাসরি এস আলম গ্রুপের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। আবার রিজার্ভ চুরির তালিকাভুক্ত আসামি।
এই অসাধু গোষ্ঠী গত সরকারের আমলে ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন প্রকল্প চালুর নামে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেছেন। সম্প্রতি 'দুর্নীতিবাজ’কর্মকর্তাদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ডেপুটি গভর্নর নির্বাচনের জন্য গঠিত সার্চ কমিটি বরাবর পাঠানো চিঠিতে এসব কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্ত করে শাস্তির আবেদন জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে’ এই সংক্রান্ত একটি চিঠি সার্চ কমিটির কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে দেশের ‘সম্পদ লুটেরাদের’ প্রধান সহযোগী ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এছাড়া নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক রিজার্ভ চুরি হওয়ার তালিকাভুক্ত আসামি। তিনি দুর্নীতির অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
রিজার্ভ চুরি
রিজার্ভ চুরির পরে তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কোনো এক ব্যক্তির পরামর্শে এক মাসের মতো গোপন রাখেন। যার পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক। তার পরামর্শেই চুরি সংশ্লিষ্ট আইসিটি আলামত নষ্ট করার উদ্দেশ্যে রাকেশ আস্তানাকে আইসিটি সিকিউরিটি এক্সপার্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে চুরির আলামত নষ্ট করে দেওয়া হয়।
মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের পরিকল্পনা ও ব্যাংকের নীতি পলিসির তোয়াক্কা না করে মানি লন্ডারিংয়ে উৎসাহ দিয়েছেন মেজবাউল হক।
হাসিনাপুত্র জয়ের আইসিটি ব্যবসা:
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাতের আইসিটি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন সজীব ওয়াজেদ জয়। ব্যবসায় সহযোগিতা করেছেন সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলক, তার ঘনিষ্ঠজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হক।
তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু পদ্ধতি বিশেষ করে পেমেন্ট সিস্টেমস ও সিআইবি বাণিজ্যিকিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। কিন্তু এসব কাজ বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এর অন্যতম উদাহরণ বিনিময় প্রকল্প। ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সুইস স্থাপনের জন্য জয়, দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের যোগসাজশে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকৃত খরচের চেয়ে ২০ গুণ অর্থ ব্যয় করে বিনিময় প্রকল্প শুরু করা হয়।
এই প্রকল্প পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের ভেলওয়ার লিমিটেড সঙ্গে অর্ধেক লভ্যাংশ শেয়ারের জন্য একটি চুক্তি করা হয়। ভারতের টাইম ইন্ডিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে 'টাকা পে ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড' প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
জয়ের মালিকানাধীন হোম পে নামে প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ মালিকানায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ভারতের যে কোনো এআইএম থেকে টাকা উত্তোলনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (এনপিসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ডেটা সেন্টারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের কাজ চলমান আছে। জয়ের ব্যবসায়ীক ক্ষেত্র বৃদ্ধির জন্য দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমের সব পদ্ধতি বেসরকারিকরণের জন্যে যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করে রেখেছেন। তবে এবিষয়ে দাপ্তরিক কোনো সার্কুলার হয়নি।
ডাটা সেন্টারে দুর্নীতি:
দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হকের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটা সেন্টার বেসরকারি খাতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব আইসিটি সিস্টেমস কেনাকাটা দেবদুলালের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে। প্রকিউরমেন্ট সেকশনটি তাঁর সহযোগী জনবল দিয়ে সাজিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে দেবদুলাল রায়ের দুর্নীতির অন্যতম প্রধান সহযোগী সিনিয়র সিস্টেমস অ্যানালিস্ট মশিউজ্জামান খান। দেবদুলাল মশিউজ্জামান খানকে অন্যান্য ব্যাংকের বিভিন্ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতেন তার প্রভাব বিস্তার করার জন্য।
দেবদুলাল ও আটক হওয়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক একই স্কুলের ছাত্র হওয়ায় পলক দেবদুলালকে ও মেজবাউল হককে জয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সহ ব্যাংকিং সেক্টরের আইসিটি কে নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও ক্রয় কাজে সিন্ডিকেট তৈরি করেন। এছাড়াও সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী পুত্র, দেবদুলাল ও মেজবাউল হক মিলে পেমেন্ট সিস্টেমস এবং আইসিটি বিভাগের সকল ক্রয় সংক্রান্ত কাজে বিভিন্ন আইসিটি পণ্যের উৎপাদক, ডিস্ট্রিবিউটর ও সরবারহকারি মিলে এক অবিচ্ছেদ্য সিন্ডিকেট করে ১ টাকার পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য করায়। এই কাজে দেব দুলালের সহযোগী হিসেবে মসিউজ্জামান খান, অতিরিক্ত পরিচালক (আইসিটি) কাজ করছেন ।বিভিন্ন টেন্ডার এর স্পেসিফিকেশন থেকে শুরু করে কনসালটেন্সি এর মাধ্যমে টেন্ডার থেকে দেবদুলাল এর ছত্রছায়ায় প্রচুর অবৈধ অর্থ আয় করেছেন মসিউজ্জামান খান। সেকশনের ওপর থেকে নিচের সব কর্মকর্তার তালিকায় আছে আইসিআই বিভাগের দুজন পরিচালক (তৃতীয় গ্রেড)। তাঁরা হলেন চন্দন সাহা ও পঙ্কজ কুমার মল্লিক।
অতিরিক্ত পরিচালকদের (চতুর্থ গ্রেড) মধ্যে বিষ্ণু পদ বিশ্বাস, যুগ্ম পরিচালক (পঞ্চম গ্রেড) প্রকাশ চন্দ্র মণ্ডল, উপপরিচালক (ষষ্ঠ গ্রেড) মিথুন সরকারের সমন্বয়ে সাজিয়ে নিয়ে অপকর্ম করা হচ্ছে।
সিআইবি সফটওয়্যারে অনিয়ম
দেবদুলাল সিআইবি সফটওয়্যারে সব কন্ট্রোল নিয়ে কর্মকর্তাদের কর্মহীন করে রেখেছেন। ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ তথ্য আপডেট করার এবং সিস্টেমে তা নয়ছয় করার কন্ট্রোল দেবদুলাল নিজের হাতেই রেখেছেন। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে চলমান সিবিএস ভারতীয় প্রতিষ্ঠান টাটা কনসাল্টিং সার্ভিসেস (আইসিএস) থেকে কেনা। মেজবাউল হক ও দেবদুলাল রায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এই কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম এস আলমের এজেন্ট। তিনি বিগত সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি ব্যাংককে অনৈতিক সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে প্রচুর অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
তিনি প্রায়শই নিজের আখের গোছাতে ব্যাংকের স্বার্থবিরোধী কাজ করতেও পিছপা হননি। এমন পরিস্থিতিতে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তবে ওই চিঠিতে প্রকাশিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক এবং নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি) দেবদুলাল রায়ের নাম থাকলেও এর বাইরে আরো অনেক কর্মকর্তা আছেন; যারা বিভিন্ন সময় অনেক সবল ব্যাংককেও দুর্বল করে ছেড়েছেন, নামে বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংকের টাকা লুট করেছেন, বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপকে নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে বিশাল অংকের অর্থ ঋণ দিয়ে লুট করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তারা একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব অপকর্ম করার সুযোগ পেয়েছেন।
মোঃ মোতাসিম বিল্লাহ, সারোয়ার, নওশাদ, শাহরিয়ার, ইশতিয়াক, আসাদুজ্জামান খান এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকে নীরবে গড়ে ওঠা এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী এবং দুর্নীতিবাজ। এদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মূলত নির্বাহী পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন সিরাজ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগ। এরা নিয়োগ, বদলী ও পদোন্নতিসহ আওয়ামী বলয়ে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলুষিত রাজনীতির ভিতর প্রবেশ করায়। এরাই মূলত আওয়ামী ঘরানার বেশ কয়েকটি ব্যাংক পরিচালনার নেপথ্যে ভূমিকা পালন করে। এস আলম গ্রুপের নামে বিভিন্ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় এদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে মোতাসিম বিল্লাহ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে থেকে ব্যাংকের নানা অনিয়ম করার সুযোগ করে দেন।
অভিযোগ রয়েছে যে, এই দুর্নীতিবাজ চক্রটি শুধু নিয়োগ বা বদলি বাণিজ্য নয় অনেক সময় গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরের কাজেও হস্তক্ষেপ করেছেন। ডলার সিন্ডিকেটের সাথে রয়েছে এদের ঘনিষ্ঠ সখ্যতা। বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপকে সহযোগিতা করে এরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আরো অভিযোগ রয়েছে যে, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান নগদের লাইসেন্স প্রাপ্তিতে এদের নেপথ্য ভূমিকা ছিল। লাইসেন্স প্রদানের বিনিময়ে এরা নানারকম অনৈতিক ফায়দা লুটেছে এই প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে। বর্তমানে এরা পরিচালক পদে কর্মরত রয়েছে। ইতিপূর্বে জেডি (জয়েন্ট ডিরেক্টর) এবং ডিজিএম পদে থেকে নানা সুবিধা আদায় করে নিয়েছে।
এই চক্রের সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে বদলী করা হলেও এরা ঘুরেফিরে একই স্থানেই থাকছে। এদের প্রত্যেকের স্ত্রী সন্তানের নামে সম্পদের পাহাড় রয়েছে। এরা স্বজনদের নামে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা বাণিজ্যও পরিচালনা করে আসছে। দুর্নীতিবাজ এই সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের ব্যাংক একাউন্ট তদন্ত করার প্রয়োজন। যদি সুষ্ঠু তদন্ত করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, এদের আত্মীয়রাও কয়েকশত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দাবি, যেসব কর্মকর্তা গত ১৫ বছরে দেশের আর্থিক খাতে বেপরোয়া হয়ে যে পরিমান দুর্নীতি করেছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার ঋন জালিয়াতি করে দেশের সম্পদ লুটে সহযোগিতা করছেন, তাদের বিষয়ে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
দীর্ঘ দিনে গড়ে ওঠা শক্তিশালী এই সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে যত চেষ্টাই করা হোক না কেন বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্নীতির কালো থাবা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না কখনোই। এমনকি আওয়ামী ঘরনার এই সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে কোন গভর্নরের পক্ষেই বাংলাদেশ ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর নয়।