আশা-নিরাশার দোলা চলে কপ-২৯
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে চলছে কপ-২৯ এর সম্মেলন। দিন দু'য়েকের মধ্যে শেষ হতে যাচ্ছে এই অনুষ্ঠান। প্রধানত দু'টি বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কপ সম্মেলনের জন্ম হয়েছে। ভবিষ্যত পৃথিবীকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যাবহারকারী দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করা।
যে যাইহোক, কপ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় খলনায়কের চরিত্রে থাকা দেশগুলোই। ইতিবাচক কথা বরলেও তা আর বাস্তবায়ন হয় না শেষ পর্যন্ত। তারপরেও আশা-ভরসা নিয়েই জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারকানী দেশগুলোর বিরুদ্ধে পরবর্তী যুদ্ধে অংশ নিতে কপ সম্মেলনে উপস্থিত হন ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতিনিধিরা।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কাঠামো কনভেনশন এর আওতায় এবারের বার্ষিক সম্মেলন কপ-২৯ অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। ১১ নবেম্বর শুরু হয়ে শেষ হবে ২২ নভেম্বর।
বিশ্বব্যপী জলবায়ু পরিবর্তন একটি ধীর প্রক্রিয়া হলেও এর প্রভাব খুব মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। বৈরিভাবাপন্ন আবহাওয়া, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, আকস্মিক বন্যা, নদীভাঙন, খরা, দাবানল, বনভূমি সংকোচন, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া, কিংবা অনাবৃষ্টিজনিত কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার মতো সমস্যাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংগঠিত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হিসেবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করা হচ্ছে। নাসার জিআইএসএসের বিশ্লেষণী প্রতিবেদন বলছে, ১৮৮০ সালের পর থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অন্তত ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে। সব থেকে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় এড়াতে হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা যেকোনো মূল্যে কমাতে হবে। ২০১৫ সালের কপ-২১ সম্মেলনে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে এবং ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এলক্ষ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেকে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তবে যেসব রাষ্ট্র শিল্পোন্নত দেশগুলোর অবিবেচনাপ্রসূত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করার বিষয়ে ২০০৯ সালের কপ-১৫ কোপেনহেগেন সম্মেলনে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়েছিল। এ লক্ষ্যে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর কপ-২৬ সম্মেলনে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মিসরের শারম আল শেখের কপ-২৭ সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ নামে একটি বিশেষ ফান্ড গঠনের বিষয়ে সবাই সম্মত হয়েছিল। ২০২৩ সালে দুবাইতে কপ-২৮ সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে প্রায় ৭০ কোটি ডলার অনুদানের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অনীহা ও মানবিক সদিচ্ছার অভাবে এই প্রকল্প যথাযথ আলোর মুখ দেখতে পায়নি। পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং পরবর্তী সম্মেলনগুলোর গৃহীত অঙ্গীকারগুলোও।
এতদসত্ত্বেও আজারবাইজানের বাকুতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, বিপর্যস্ত দেশগুলোকে সহায়তা প্রদান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণকে সামনে রেখে বিশ্বনেতাদের নিয়ে কপ-২৯ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের সম্মেলনে আর্থিক সহায়তার একটি নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা চলছে। চেষ্টা চলছে জলবায়ু পরিবর্তিত পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বিপর্যস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ২০৩৫ সালের মধ্যে কীভাবে এক ট্রিলিয়নের অঙ্কে পৌঁছানো যায়। তবে এবারের সম্মেলনটি এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার নির্বাচিত হয়েছেন। তাছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এ সম্মেলনে যোগদানই করেননি।
এবারের কপ-২৯ সম্মেলন শুরুর আগেই দেশের পূর্বাঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর জেলা এক ভয়াবহ আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ে। তাছাড়া কয়েক বছর ধরে দেশ ভয়াবহ দাবদাহ ও বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তীব্র বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন থেকে এ পর্যন্ত কার্বন নির্গমনের পরিমাণ শূন্য দশমিক আট শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে সুন্দরবন সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোয় শুকনো মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়া ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো অহরহ ঘটছে। তাই সম্মেলনে বাংলাদেশের নজর ছিল তার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উদ্বেগ ও ক্ষয়ক্ষতি উত্থাপনের বিষয়ে। ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলা ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিযোজনের জন্য বরাদ্দকৃত আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে সোচ্চার ছিল। আর্থিক সহায়তার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা শিল্পোন্নত দেশগুলোর অনীহা এবং বিপর্যস্ত দেশগুলোর দর-কষাকষির বিষয়টির তীব্র সমালোচনা করেছেন। সম্মেলনে তিনি তার দীর্ঘদিনের লালিত বিগ থ্রি জিরোর ধারণা উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে একটি ভিন্ন জীবনধারার পরামর্শও দিয়েছেন।