প্রধান প্রকৌশলীর প্রত্যক্ষ ইন্ধনে
অনিয়ম-দুর্নীতি ও সমঝোতায় চলছে গণপূর্ত
গণপূর্ত অধিদপ্তরে থামছেই না অনিয়ম-দুর্নীতি। অধিদপ্তরে কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত। গণমাধ্যমে এসব নিয়ে মাঝে-মধ্যেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়, মামলা হয়। দুর্নীতি প্রমাণীত হয়। দন্ড হয়। কেউ আইনের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে পারও পেয়ে যান। তারপরেও থামে না অনিয়ম-দুর্নীতি।
এছাড়া, বছর শেষে প্রতিবারই অনিয়মের সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার অডিট আপত্তি থাকে। দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ থাকে। শেষাব্দি তা কোনো না কোনোভাবে নিষ্পত্তি হয়ে যায় অথবা চিঠি চালাচালির মধ্য দিয়ে কেটে যায় ২০-৩০ বছরও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের একাধিক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ অধিকাংশ নির্বাহী প্রকৌশলী দরপত্র আহ্বান সংক্রান্ত অনিয়মে জড়িয়েছেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অধিদপ্তরের অধিকাংশ অতিরিক্ত, তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলী পিপিআর ও জিএফআর লঙ্ঘন করেছেন ঢালাওভাবে। মানেননি মন্ত্রী পরিষদের নির্দেশনা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর ও মূসক নির্দেশনাও। লঙ্ঘন করেছেন ট্রেজারি রুলের সাবসিডিয়ারি রুল (এসআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ বিভাগ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অনুবিভাগ এর নির্দেশনা। পাশাপাশি সিপিডব্লিউ ‘এ’ এবং সাব ডেলিগেশনও লঙ্ঘন করেছেন। মানেননি ইজারার সাধারণ শর্তাবলীও। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ওপেন টেন্ডার মেথড (ওটিএম) ভেঙে করেছেন লিমিটেড টেন্ডার মেথড (এলটিএম)।
গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আকতারের (স্বঘোষিত পীর) সময়ে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। এই পীর গণপূর্ত অধিদপ্তরকে নিজের আস্তানা বানিয়েছেন। অনিয়মের সাথে জড়িত এসব প্রকৌশলীর একটি অংশ তার মুরিদ হয়েছেন। এর বাইরে ঠিকাদারের একটি গ্রুপ রয়েছেÑ যারা তার মুরিদ। মুরিদ হলেÑ অনিয়ম করে পার পাওয়া যায়। ঠিকাদারি করলে দরপত্রের কাজ পাওয়া সহজ হয়। পীরের বিরুদ্ধে অধিদপ্তরের কেউ কথা বললে তার বদলী আদেশের চিঠি চলে আসে। এই ভয়ে অনেকে তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। ঠিকাদার মুরিদ এবং কিছু অধনস্ত মুরিদ নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে অধিদপ্তরে রাজত্ব করছেন গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আকতার। তার নেতৃত্বেই চলছে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি।
সম্প্রতি প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় তিনি কাউকে বদলী করতে পারবেন না মর্মে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রলায় অধিদপ্তরে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত স্মারক নম্বর- ২৫.০০.০০০০.০১৩.৯৯.০১৩.১২-৭২১ এর মাধ্যমে প্রধান প্রকৌশলী শামীম আকতারের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। তিনি অধিদপ্তরের কোনো ধরনের বদলীর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এইমর্মে চিঠি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। যদিও সে নিষেধাজ্ঞা পরবর্তীতে তুলে নেয়া হয়।
এছাড়াও ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৩ আব্দুল্লাহ আল খায়রুম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো হয়। চিঠিতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও এইচবিআরআই এর প্রাক্তন মহাপরিচালক মোহাম্মদ শামীম আকতারকে লেবাসধারী ভণ্ডপীর ও দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করা হয় এবং শামীম আকতারের দুর্নীতির বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশের প্রেক্ষিতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠন করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি এই কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিকে পরবর্তী ১৫ কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পীর সাহেবের কেরামতির কারণে ওই প্রতিবেদনটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর পদে আসার আগে শামীম আখতার ছিলেন হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) মহাপরিচালকের দায়িত্বে। সেখানে কোনো কোনোক্ষেত্রে প্রকল্প পাস না করে, কখনো টেন্ডার হওয়ার আগে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ পেয়ে যান মুরিদ ঠিকাদাররা। মাসে লাখ টাকা বেতনে প্রকল্পের পরামর্শক, কর্মকর্তা-প্রকৌশলী থেকে বাবুর্চি-মালির মতো পদগুলোয় পান নিয়োগ। মুরিদদের সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন মহাপরিচালকের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে এইচবিআরআই থেকে একটি তদন্ত কমিটি। মুরিদদের ঠিকাদারিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে এইচবিআরআইয়ের এ তদন্ত প্রতিবেদন।
২০১৯ সালের এপ্রিলে ‘নন ফায়ার ব্রিক প্ল্যান্ট’ নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিংডম বিল্ডার্সের সঙ্গে চুক্তি করে এইচবিআরআই। আইন অনুযায়ী, ১০ থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এমনকি এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে এইচবিআরআইয়ের বাজেটও নেই। তার পরও ‘নন ফায়ার ব্রিক প্ল্যান্ট’ নির্মাণের প্রায় ১৪ কোটি টাকার কাজ কিংডম বিল্ডার্সকে দেন সংস্থাটির তৎকালীন মহাপরিচালক। কিংডম বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুসরত হোসেনকে পীর সাহেবের ঘনিষ্ঠ মুরিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এইচবিআরআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে। কিংডম বিল্ডার্স, কিংডম হাউজিং, কিংডম কনস্ট্রাকশনসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নুসরত হোসেন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে এইচবিআরআইয়ের গবেষণা খাতে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এ টাকা থেকে ১ কোটি ১১ লাখ টাকায় ‘অটোমেটিক ব্লক মেকিং প্ল্যান্ট’ স্থাপনের কাজও পায় কিংডম বিল্ডার্স। এ ধরনের কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থার অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রকৌশলীদের নিয়ে কমিটি গঠনের নিয়ম থাকলেও সে ধরনের কোনো কমিটিই হয়নি। অন্যদিকে একই প্ল্যান্টের শেড নির্মাণের জন্য ৭০ লাখ টাকার কাজে কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই কিংডম বিল্ডার্সকে নিযুক্ত করা হয়। অর্ধকোটি টাকায় একই কাজ আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অর্থি এন্টারপ্রাইজকে দেয়া হয়, যার মালিক আল আমীনকেও পীর সাহেবের মুরিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এইচবিআরআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে।
দৈনিক ২০ ঘনমিটার ব্লক উৎপাদন শুরু করার লক্ষ্যে ‘এসিসি প্ল্যান্ট’ উন্নয়নকাজে ২০১৯ সালে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। কাজটি করে কিংডম বিল্ডার্স, অর্থি এন্টারপ্রাইজ ও জামান বিল্ডার্স।
একই সময়ে প্রায় ১ কোটি টাকায় এইচবিআরআইয়ে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণের কাজ পায় কিংডম বিল্ডার্স। অন্যদিকে দরপত্রের আগেই অফিস সংস্কারের কাজ শুরু করে দেয় অর্থি এন্টারপ্রাইজ।
এইচবিআরআইয়ের মহাপরিচালক থাকাকালে পীর সাহেবের আরেক ঘনিষ্ঠ মুরিদ ছিলেন মোহাম্মদ ইয়ামীন। ক্যামিকন গ্রুপ নামের একটি কেমিক্যাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা বেতনে ইয়ামীনকে স্যান্ড সিমেন্ট ব্লক তৈরির কাজে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেন এইচবিআরআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মদ শামীম আখতার। কোনো টেন্ডার ছাড়াই আড়াই কোটি টাকার কাজ দেন ইয়ামীনকে। নিযুক্ত করেন গবেষণার কাজে। এইচবিআরআইয়ের টাকায় গবেষণা করে উৎপাদন করা কেমিক্যাল এইচবিআরআইয়ের কাছেই বিক্রি করেছেন ইয়ামীন।
মোহাম্মদ শামীম আখতারের এসব অনিয়ম-দনর্িীতির বিষয়ে এইচবিআরআই ও দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক চিঠিও দিয়েছেন এইচবিআরআইয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এইচবিআরআই এর এসব অনিয়ম-দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন (৩৭৩ পাতা) গণপুর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। এমন কি দুদককে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ বা নির্দেশও দেয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে ক্ষতিগ্রস্থরা দুদক চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। সর্বশেষ ৬৬৬ এ কল করে বিষয়টি তদন্তের দাবী জানান। গত ৩ নভেম্বর ২০২২ তদপ্রেক্ষিতেই দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের স্মারক নং ০০.০১.০০০০.১০৯.২৮.০০১.২২.১৬৬৪ মোতাবেক বিষয়টি তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আকতারের কার্যালয়ে একাধকিবার গিয়েও তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তার স্টাফ অফিসার মো মাহফুজুল আলমের কাছে প্রধান প্রকৌশলীর সাথে সাক্ষাতের সময় চাওয়া হলে তিনি পরের দিন সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিবেন বলে জানান। মাহফুজুল আলম বলেন, যাবার আগে তার মুঠোফনে যোগাযোগ করে যেতে। তিনি প্রধান প্রকৌশলীর সাথে সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করে জানাবেন। পরের দিন স্টাফ অফিসারকে বেশ করেকবার ফোন করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি এবং স্টাফ অফিসারের কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।