আপনার ব্যাক পেইন সম্পর্কে জানা-অজানা কথা
ব্যাক পেইন বা মেরুদন্ডের ব্যথা আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত একটি সমস্যা এবং প্রায়ই আশেপাশের সব বয়সের নারী, পুরুষ, যুবক, যুবতী, বৃদ্ধ , বৃদ্ধা হতে শুরু করে বাচ্চারাও এই সমস্যার শিকার হতে পারেন, যা দৈনন্দিন জীবনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। সাধারণ হোক বা গুরুতর, ব্যাক পেইন মানুষের দৈনন্দিন কাজের গতিশীলতা, উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয় এবং মানসিক যন্ত্রণা বৃদ্ধি করে।
ব্যাক পেইনের কারণ সমুহঃ
* মাসেল স্ট্রেইন বা মাংসপেশীতে টান: এটি ব্যাক পেইনের অন্যতম একটি বড় কারণ। অস্বাভাবিক ভাবে দেহের অবস্থান, ভুল কৌশল বা পদ্ধতিতে ভার উত্তোলন, অপ্রস্তুত বা হঠাৎ নড়াচড়া ইত্যাদি কারণে মেরুদণ্ডের আশপাশের পেশী ও লিগামেন্টগুলোয় চাপ লাগতে পারে, ফলে পেশীতে ব্যথা বা পেশী শক্ত অনুভব হতে পারে।
* হার্নিয়েটেড ডিস্ক: মেরুদন্ডের দুই হাড়ের মধ্যবর্তিী ডিস্কের ভিতরের নরম স্তর ও বাইরের শক্ত স্তর সরে যাওয়াকে হার্নিয়েটেড ডিস্ক বা স্লিপড ডিস্ক বা পি আইভিডি বলা হয়। এর ফলে আশপাশের স্নায়ুগুলো সংকুচিত হয়, যা মেরুদন্ডে ব্যথা, অসাড়তা এবং শরীরে অস্বস্তিকর অনুভূতি করে।
* অস্টিও আর্থ্রাইটিজ: অস্টিওআর্থ্রাইটিজ-সহ অন্যান্য আর্থ্রাইটিস মেরুদণ্ডে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী ব্যাক পেইন দেখা দেয়। আর্থ্রাইটিজ জয়েন্টগুলো কার্টিলেজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যা জোড়ার প্রদাহ, জোড়ার শক্ত হয়ে যাওয়া এবংজোড়ার অস্বস্তি সৃষ্টির কারণ হয়।
* অস্টিও পোরোসিসঃ বয়স জনিত কারনে মানবদেহের হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়ে , হাড়ের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন রকম কমপ্লিকেশন তৈরি করে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকারে ব্যথা ও ব্যথা সম্পর্কিত জটিলতা তৈরি করে।
* স্পাইনাল ক্যানেল স্টেনোসিস: এটি বলতে মেরুদন্ডের নালীর সংকীর্ণতা বোঝায়, যা মেরুদন্ড ও স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে বয়সের সাথে সাথে মেরুদণ্ডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ব্যাক পেইন এর সাথে হাত ও পা ব্যথা, বেশীক্ষন বসা বা দাড়ানো বা হাঁটায় সমস্যা সহ বিভিন্ন অসুবিধা হতে পারে।
ব্যাক পেইন প্রতিকারে করণীয়ঃ
* স্বাভাবিক দেহ অবস্থান বজায় রাখা: ব্যাক পেইন নিয়ন্ত্রণে বা প্রতিরোধে স্বাভাবিক দেহভঙ্গি বজায় রাখা ও এর চেষ্টা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বসা, দাঁড়ানো, শোয়া সকল ক্ষেত্রেই শরীর বিশেষ করে পিঠ সোজা ও কাঁধ শিথিল রাখতে হবে এবং কুঁজো হয়ে থাকা পরিহার করতে হবে। ঝুঁকি কমাতে ঘরের আসবাব ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সুবিধা মতো স্থানে রাখা যেতে পারে।
* শরীরচর্চা: নিয়মিত শরীরচর্চা পেশীগুলোকে মজবুত করে, যা মেরুদণ্ডকে সাপোর্ট দেয় এবং আরও ফ্ল্যাক্সিবল হতে সাহায্য করে। সাঁতার, হাঁটা, যোগব্যায়ামের মতো অভ্যাস ব্যাক পেইন নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ উপকারী। তবে শুরুটা করতে হবে আস্তে-ধীরে এবং সেক্ষেত্রে ব্যাক পেইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
* ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন ব্যাক পেইন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই উচ্চতা অনুযায়ী ওজন স্বাভাবিক রাখতে সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, অতিরিক্ত চাপ থেকে মেরুদণ্ডকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।
* সঠিক কৌশলে ভারী বস্তু ওঠানো: পিঠে বাড়তি চাপ এড়াতে কোন ভারী বস্তু উত্তোলনে সঠিক কৌশল ব্যবহার করা অপরিহার্য। হাঁটু বাঁকিয়ে, বস্তুটি শরীরের কাছাকাছি এনে, পিঠের উপর জোর না দিয়ে পায়ের পেশীর সাহায্য নিয়ে বস্তুটি তুলতে হবে।
* হিট এবং কোল্ড থেরাপি: আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে গরম বা ঠান্ডা কিছু লাগালে পিঠের ব্যথা থেকে সাময়িক উপশম পাওয়া যায়। তাপ পেশী শিথিল করতে সাহায্য করে এবং রক্ত প্রবাহ গতিশীল রাখে এবং ঠান্ডা থেরাপি পেশীতে প্রদাহ কমায়।
* মেডিকেশন এবং অল্টারনেটিভ থেরাপী: হালকা থেকে মাঝারি ব্যাক পেইনে এ্যানালজেসিক বা অন্যান্য ব্যথার ওষুধ সাময়িক সাহায্য করে। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকি এড়াতে এই ধরনের কোনো ওষুধ সেবন করার আগে অবশ্যই একজন ব্যাক পেইন বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা উচিত। এছাড়াও, ইলেক্ট্রোথেরাপি, আকুপাংচার, এবং অন্যান্য ম্যানুয়েল থেরাপিগুলো এই ব্যাথা প্রশমনে স্বস্তি প্রদান করতে পারে।
* স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং রিলাক্সেশন কৌশল: মানসিক চাপ ব্যাক পেইনের লক্ষণগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ও একনিষ্ঠ মনে ধ্যানের থেরাপীগুলোতে স্ট্রেসের মাত্রা কমাতে এবং পিঠের ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করতে পারে। পিরিমিত ঘুম আমাদের ব্যাক পেইন কমাতে সহায়তা করে থাকে।
কখন ব্যাক পেইন বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের সাহায্য নিবেন মূলত, ব্যাক পেইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা এবং যত্নের মাধ্যমে প্রশমন করা যায় তবে সেখানে অবশ্যই চিকিৎসার উপর মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
একজন ব্যাক পেইন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন যদি:
• পিঠে ব্যথা কয়েক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে বা সময়ের সাথে সাথে আরও খারাপ হয়।
• উরু বা পায়ের নিচের ব্যথা বাড়তে থাকে বা দুর্বলতা ও অসাড়তা ভাব অনুভুত হয়। হাত ও পায়ে ব্যথা বাড়তে থাকে বা দুর্বলতা ও অসাড়তা ভাব অনুভুত হয়
• পিঠে আঘাত বা পূর্ববর্তী আঘাতের ইতিহাস রয়েছে।
• অন্ত্র বা মূত্রাশয়ের কর্মহীনতার সাথে পিঠে ও পায়ে ব্যথা হয়।
ব্যাক পেইন একটি অবস্থা যা একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রাকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। একটি সুস্থ শরীর বজায় রাখতে প্রাত্যহিক ব্যায়াম করা, ওজন নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রফেসর ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর
বি পি টি, এম ডি, এম পি এইচ, এম ডি এম আর, পি এইচ ডি
কনসালটেন্ট ফিজিওথেরাপিস্ট ও বিভাগীয় প্রধান
ফিজিওথেরাপি মেডিসিন এন্ড রি-হ্যাবিলিটেশন বিভাগ
ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, মতিঝিল, ঢাকা
মোবাইলঃ ০১৬৪১৫৭৬৭৮৭, ০১৭৩৮৩৯৪৩০৯