শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্য: অল্পশ্রুত এক মহান দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি
ইতিহাসেরও অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থাকে। খ্যাতিমান আর বিখ্যাতদের ভিড়ে কম বিখ্যাত বা অপেক্ষাকৃত কম খ্যাতিমান বহু মহান দেশপ্রেমিক সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে চাপা পড়ে থাকেন। কখনো তাঁদের খোঁজ কেউই নেয় আবার কখনো নেয়ই না। অথচ একটি জাতির ইতিহাস নির্মাণে তাঁদের থাকে মহান ত্যাগ ও অবিস্মরণীয় আত্মদান।
তাঁদের একজন টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়া গ্রামের সৎসঙ্গী, সহ প্রতি ঋত্বিক, লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব শহীদ প্যারী মোহন আদিত্য(১৯৩৪-১৯৭১)। শহীদ প্যারী মোহন আদিত্য ১৯৩৪ সনের ৫ জুন সাবেক টাঙ্গাইল মহকুমার বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়া গ্রামের শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুকুল চন্দ্রের সৎসঙ্গ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা আদিত্য পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
বাবা ছিলেন লৌহশিল্পী বা লোহা ব্যবসায়ী। তাঁর নিজস্ব কামারশালা ও মোদি দোকান ছিল। মা ছিলেন সর্বংসহা মহামায়া দেবী তথা মহামায়া আদিত্য। চার ভাইয়ের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্য ছিলেন দ্বিতীয়। শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুকুল চন্দ্র পুরুষোত্তম প্রথাগত শিক্ষা ও আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার কুফল সম্পর্কে সদা-সচেতন ছিলেন। তিনি জীবনমুখী বাস্তববিদ্যা ও অধ্যাত্মবিদ্যার একজন একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুকুল চন্দ্রের অন্যতম শিষ্য প্যারী মোহন আদিত্য তিনি তাঁর বাবার কামার শালায় সহযোগিতা দান, মুদিখানার কাজের পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা, গান, নাটক, আবৃত্তি, সমাজসেবা, যাত্রাপালা ও পত্রিকা সম্পাদনায় অধিক মনোযোগী ছিলেন। ১৯৫০ সনে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার ঘাটাইল থানার পাকুটিয়া গ্রামে শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুকুল চন্দ্র পুরুষোত্তম পরম ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। অত্র অঞ্চলের মাত্র তিন/চারটি সৎসঙ্গ পরিবারের সহযোগিতায় আশ্রম পরিচালিত হতে থাকে অত্যন্ত দীনভাবে।
১৯৫৮ সনে প্যারী মোহন আদিত্য ভারতের বিহার প্রদেশের দেওঘর থেকে শ্রীশ্রীঠাকুরের মহামূল্যবান পাদুকাশ্রী এনে পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে স্থাপন করেন। জাগ্রত দেবতা চরণ স্পর্শে সৎসঙ্গীদের সেবা কার্যক্রম ও মানবসেবা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আশ্রমের সহ-সম্পাদক হিসেবে হাল ধরেন সহ প্রতি ঋত্বিক, শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্য। ঠাকুর সেবা, ত্রিসন্ধ্যা, দীনে প্রেম, নাম সংকীর্তন অধ্যত্মবিকাশ সহ নানা মহৎকর্মে প্যারী মোহন আদিত্য নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
ষান্মাসিক ‘সৎসঙ্গ’ পত্রিকা সম্পাদনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকেন। পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতি কর্মকাণ্ডে এবং সমাজ সেবা মুলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। অল্প দিনেই প্যারী মোহন আদিত্য এলাকার সকলের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়ে উঠেন। হাজার বছরের শোষণ ও পাকিস্তানীদের হাত থেকে জাতিকে মুক্ত করার ডাক দেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু হয় বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ। সংগঠিত বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে ৯ মাস।
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, আহার, চিকিৎসা সুবিধা নিয়ে গোপনে গোপনে এগিয়ে আসেন প্যারী মোহন আদিত্য। সৎসঙ্গ আশ্রম হয়ে উঠে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বুকে আগলে রাখেন প্যারী মোহন আদিত্য জাতির এসব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। পরিণতি নেমে আসে ভয়াবহ। স্থানীয় রাজাকারদের যোগসাজসে নির্মমভাবে প্রাণ হারান দেশ মাতৃকার এই শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক সাধুবীর সন্তান প্যারী মোহন আদিত্য। পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমের উপর মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তিন তিন বার ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালিত হয়।
সর্ব প্রথম ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরা টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য ঘর বাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়, পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে পর পর শেল আঘাত করে মন্দিরের শীর্ষ চূড়া গুড়িয়ে দেয়। অল্পের জন্য সাধক ঋত্বিক পুরুষ প্যারী মোহন আদিত্য পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পরিবারসহ বেঁচে যান। আবার সেবাধর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
একমাস পরেই ১৯৭১ সনের ২১ মে আবার পাকিস্তানি ও তাদের দোসরা অতর্কিত হামলা চালায় পাকুটিয়া বাজার ও পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে সারশি অভিযান চালায়। গ্রেফতার হন প্যারী মোহন আদিত্য। তাঁকে থানা সদর ঘাটাইল ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। অকথ্য নির্যাতন চলে তাঁর উপর। অলৌকিক ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। অবশেষে আসে পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমের জীবনে ভয়াবহ কালোদিন। ১৯৭১ সনের ৮ আগস্ট সৎসঙ্গ আশ্রম আবার আক্রান্ত হয়। মূহুর্মূহু গুলি চলতে থাকে।
সাধক পুরুষ প্যারী মোহন আদিত্য পালানোর সুযোগও পান না। মন্দির প্রাঙ্গণে ধ্যানস্থ সমাধি গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর তল পেটে গুলি চালায়। তিনি ভূমিতে লুটিয়ে পড়েন। চালানো হয় ব্যানেট ও ছুরিকাঘাত, জিজ্ঞেস করতে থাকে নরপশুর দল মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। দেশ প্রেমিক প্যারী মোহন আদিত্য নির্বাক থেকে নির্যাতিত হতে হতে দেশের তরে জীবন উৎসর্গ করেন । অবুঝ শিশুপুত্র নটো কিশোর আদিত্য আর আমাদের সকলের কিশোরী বধূঁমাতা তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী বীণা রানী আদিত্যকে রেখে সন্ন্যাসী দেবতুল্য ঋত্বিক সাধক পুরুষ এভাবে দেশের জন্য লড়াই করে প্রাণ দিলেন। ভয়ে আতংকে তিন দিন পর্যন্ত তাঁর লাশ পরে রইল মন্দির প্রাঙ্গণে।
অবশেষে বড়ভাই সৎসঙ্গ সম্পাদক রাসবিহারী আদিত্য ও পরিবারের লোকজন গোপনে ও চুপিসারে বাড়ির পাশে তাঁর বাবা ও মায়ের সমাধির নিকট শেষকৃত্য সম্পন্ন করলেন। হায়রে! ইতিহাস কি নির্মম! কোন ইতিহাসবিদদের কলমে আজও এ ইতিহাস লিপিবদ্ধ হলো না। ইতিহাসে স্বাধীনতার কৃত্বিত্ব নিয়ে কত জনেরই না বাড়াবাড়ি! কিন্তু প্যারী মোহন আদিত্যরা বা যারা জীবন দিয়ে দেশ ও ইতিহাস রচনা করলেন, সেই ইতিহাসই তাদেরকে ধারণ করল না। পরের ইতিহাস আরও মর্মন্তুদ! করুণ!, হৃদয় বিদারক! ১৬/১৭ বছরের বিধবা বধূঁমাতা বীণা রানী আদিত্য স্বামী শোকে মানসিক বৈকল্যে মারাত্নকভাবে আক্রান্ত হলেন।
তিনি শিশুপুত্রকে রেখে নিরুৎদ্দেশ হলেন। আর কোথাও তাঁকে পাওয়া গেল না। এমনকি তার মৃতদেহের খোঁজও মিলল না। আজ তাঁদের পুত্র ৫০ বছরের নটো কিশোর আদিত্য পত্রিকা সম্পদনা করে পেটের ভাত জোগাড় করতে ব্যস্ত। তাঁর বাবার মহান আত্মদানের কোন প্রকার স্বীকৃতি নেই। মায়ের আত্মদানের স্বীকৃতির জন্যও কোন মাথা ব্যাথাই নেই রাষ্ট্রের। বিচারের বাণী নীরবে নিবৃত্তে কাঁদে। তাই বলে মানুষ বৈঈমান নয়। পাকুটিয়ার সর্ব সাধারণ শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্যের নামে একটি রাস্তার নামকরণ করেছেন এবং সৎসঙ্গ বাংলাদেশ পাকুটিয়া সৎসঙ্গ তপোবন বিদ্যালয়ের সমূখে স্মৃতি ফলক স্থাপন করেছেন।
৮ আগস্ট নয়ন জলে শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্যকে মানুষ সম্মান করে। তাঁর হত্যার পিছনে লুকিয়ে থাকা দেশীয় রাজাকার আল-বদরদের বিচার চায়। মহান দেশ প্রেমিককে স্মরনীয় করে রাখতে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে সরকারের কাছে স্বীকৃতি সহ তাঁর নামে কোন প্রতিষ্ঠান করা হোক। হয়তো রাষ্ট্র কিছু করবে না। কারণ সামর্থ্যহীন রাষ্ট্র ইতিহাসকেও তাদের করতলগত করে রাখে। তারা মসনদের মতই ইতিহাসকেও দখল করে। তবে মানব জাতির ইতিহাস মুক্ত পৃথিবী স্বাদ একদিন না একদিন পাবেই।
শহীদ প্যারী মাহন আদিত্য, শহীদ আরপি সাহা, শহীদ রবি সাহাসহ বহু শহীদ সূর্য সন্তানেরা ইতিহাসের অমলিন পাতায় জাতির বরপুত্র হিসেবে ধ্রুব নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠবেই। জয় হোক সত্যের, জয় হোক শিবের, জয় হোক সুন্দরের। সত্যম শিবম সুন্দরম। লেখক: কবি, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক।