রুমমেট আর একটি সাগর
নুসরাত রীপা
মেসের পিচ্চি রবি কে সঙ্গে নিয়ে মেইন রোডের আশেপাশের কয়েকটা বিল্ডিং এর দেয়ালে আর বৈদ্যুতিক থামে "রুম মেট আবশ্যক" ছাপানো বিজ্ঞাপনটা সেঁটে দিয়ে মইদুলের দোকানে কড়া লিকারের দুধ চা সাথে কিমা পুরি অর্ডার করে টেবিলে বসলো নাফিস। রবির তাড়া ছিলো। মেস বাসিন্দাদের টুকটাক কাজ করে দেয়া ছাড়াও মেসের রাঁধুনির কাজে সাহায্য করে তাই সে পুরি আর চা খাওয়ার জন্য বসলো না। নাফিস পকেট থেকে কুড়ি টাকার একটা নোট বের করে রবির হাতে দিতেই রবি চলে গেলো।
পাড়ার মোড়ে মইদুলের চা দোকানটা সব সময় লোকজনে গম গম করলেও আজ কেমন খালি খালি। নাফিস বসার অল্প সময়ের মধ্যেই পুরি আর চা চলে এলো। সাথে পেঁপে কুচি আর কাঁচা লংকার সালাদ। পুরিতে কামড় বসাতে বসাতে ‘আজ দোকানে লোকজন কম কেন মইদুল ভাই’ প্রশ্ন করলো নাফিস। মইদুল আপন মনে মোবাইলে গেম খেলছিল। নাফিসের কথায় মৃদু হেসে বলল, আজ তো বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ। সবাই খেলা দেখে।
আপনারে কতবার বললাম দোকানে একটা টিভি লাগান। শুনলেনইনা আমার কথা। দেখেন তো এখন যদি একটা টিভি থাকতো লোকজন খেলা দেখতে ভিড় করতো আর তখন আপনার বিক্রিও চার গুণ বেড়ে যেতো। কি বলেন, যেতো না? একনাগাড়ে কথা বলে থামলো নাফিস।
তা যেতো। কিন্তু যখন খেলা থাকবে না তখনও লোকজন খবর দেখার জন্য, মুভি দেখার জন্য, সিরিয়াল দেখার জন্য অকারণেই দোকানে আইসা বইসা থাকবে, মহল্লার লোক, পরিচিত মুখ উইঠা যাইতে বলতে পারবো না আবার আমার আসল কাস্টোমার বসার জায়গা পাবে না-- তখন ---এটুকু বলে মইদুল হাসলো। বাকিটুকু নিজের মতো বুঝে নিলো নাফিস। পুরি শেষ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে রাস্তার দিকে তাকালো। এমনিতেই আজ শুক্রবার সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। তার সাথে যুক্ত হয়েছে শীতের তীব্রতা এবং বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ। দোকানের সামনে রাস্তাটা স্থির শুয়ে আছে। দু'একজন মানুষ হেঁটে গেলো নিরব পায়ে। সামনের লাইটপোস্ট টা মনে হয় নষ্ট। আলো জ্বলছে না। ফলে নিরবতা আরো গাঢ় মনে হয়!
নাফিসের একজন রুমমেট প্রয়োজন। গলির ভেতর একটা ছয়তলা বাড়ির পুরোটাই মেস বানিয়ে ভাড়া দিয়েছে বাড়ির মালিক। বাড়িটা বেশ পুরানো। আর গলিটাও বেশ সরু। গাড়ি তো দূরের কথা রিক্সা-ভ্যান অব্দি ওর ভেতর ঢোকেনা। এসব কারণে এখানে ভাড়াও বেশ কম। ঐ মেসেই ছয় তলায় একটা রুমে থাকে নাফিস। মেসটার প্রায় সব বাসিন্দাই স্বল্প আয়ের কর্মজীবী। দু' তিন জন ছাত্র আছে। তবে তারা অনিয়মিত এবং কাজের পাশাপাশি পড়ে। এক একটা রুম চার জন থাকার ব্যবস্থা মেসে। কেবল ছয় তলার একটা ঘর দেয়াল তুলে অর্ধেক করে এক পাশে বাড়ির মালিক তার কিছু জিনিসপত্র তালা মেরে সংরক্ষণ করছে। বাকি অংশটুকু তে দুটো বেড পাতা। একটা নাফিসের। অপর বেডে যে থাকতো আবদুল করিম সে দুই মাস ধরে অনুপস্থিত। এই মেসের নিয়ম হচ্ছে কোনো রুমে সিট খালি থাকলে সেই সিট ভাড়া ঐ রুমের বাকি মেম্বাররা দেবে! নাফিস প্রতিবাদ করেছিলো। এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। কিন্তু মেসের মালিক স্পষ্ট বলেছেন, এই নিয়ম না থাকলে রুমের লোকজন ইচ্ছা করে এক বা একাধিক মেম্বার তাড়িয়ে দেবে। এটা মালিকের জন্য লোকসানের! অকাট্য যুক্তি। নাফিস অগত্যা চুপ।
গত দুইমাস ধরে আবদুল করিম আসছে না। এক মাসের অগ্রিম থাকায় মালিক ও কিছু বলে নি। কিন্তু দ্বিতীয় মাসও অতিক্রান্ত হলে মেস মালিকের টনক নড়ে। তিনি নাফিসকে ডেকে আবদুল করিমের না আসার কারণ জিজ্ঞেস করেন। নাফিস জানায়, আবদুল করিমের অনুপস্থিতি র কারণ তার জানা নাই। মেস মালিক তখন নাফিস কে নতুন রুমমেট জোগাড় করতে বলে দেন। আরো বলেন, আবদুল করিমের রেখে যাওয়া জিনিসপাতির দায় মেস মালিকের। রুমমেট না পাওয়া গেলে এ মাসের ভাড়া নাফিসের পকেট থেকে দিতে হবে। নাফিস অল্প বেতনে একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে। বিয়ে শাদী করা হয়নি তার। মোনাকে ভালোবাসতো। দুজনে অনেক স্বপ্নও দেখেছিলো। মাথায় বিশাল সাংসারিক দায় থাকায় মোনাকে আর নিজের করে পাওয়া হয়নি নাফিসের। মোনা নাফিস ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না বলে বিয়ের আগের দিন আত্মহত্যা করে। মোনার মৃত্যুর জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না নাফিস। মনে হয় দরিদ্র পরিবারের ছেলে সন্তান হওয়া ভয়ংকর পাপ। এ পাপ বয়ে বেড়াতে হয় শরীরের রক্ত মাংস আর পুরো হৃদয়টা পুড়িয়ে।
যা বেতন পায় নিজের থাকা খাওয়া বাদ দিয়ে প্রায় পুরোটাই বাড়িতে দিতে হয়। এমন অবস্থায় আরেক সিটের ভাড়া দেয়া তার জন্য সত্যিই ভীষণ কঠিন। এজন্যই এই ছুটির দিনের কুয়াশা মোড়া শীতের সন্ধ্যায় লোকজন যখন গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘরে বসে টিভিতে খেলা দেখছে, রাস্তায় যখন মানুষজন প্রায় নেই তখন রুমমেট খুঁজতে বের হয়েছে নাফিস।
দুই
দেয়ালে ফেনিল সুনীল সাগরের বিশাল বিশাল দুটো ছবি সেঁটে দিলো তোহা। সেই সাগরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিজেকে সত্যি সত্যি সাগর পাড়ে মনে হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নাফিস নতুন রুমমেট এর কাজ কারবার দেখছিলো। ছেলেটা বিজ্ঞাপন টানানোর দিনই রাতে এসে রুম দেখে অগ্রিম চুকিয়ে গিয়েছিল। আজ শুক্রবার এসে উঠেছে। সাথে অনেক গুলো কাপড়ের ব্যাগ। সে একটা করে ব্যাগ খুলছে। জিনিসপাতি ব্যাগ থেকে বের করে জায়গা মতো রাখছে তারপর ব্যাগটা ভাঁজ করে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিচ্ছে। নাফিস তাকিয়ে ছিলো। দেখছিলো নতুন রুমমেট এর কাজ। দেখতে দেখতে বোধ হয় তন্দ্রা মতো এসেছিলো একটু। তোহার ডাকে সেটা টুটে গেলো, নাফিস ভাই খেতে যাবেন না?
মেসে যে যার মন মতো সময় খাওয়া দাওয়া করে। প্রত্যেকের খাবার তার প্লেটে তুলে রাখা থাকে। ডাইনিং রুমে বিশাল এক ফ্রিজ আর একটা ওভেন আছে। যে যার মতো খাবার খায়, রাখে অথবা গরম করে নেয়।
নাফিস একটু চুপচাপ নিভৃতচারী। আসলে সংসারের নানান চিন্তায় সে সব সময় সংকুচিত থাকে। আড্ডাবাজি তাই তার ভালো লাগে না। সে খাবার খায় সবার পরে আর খুব কমই টিভি দেখতে নিচে নামে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় ম্যানেজার স্যারের রুম থেকে দৈনিক পত্রিকাটা নিয়ে আসে। অফিস থেকে ফেরার পর পুরো সন্ধ্যা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো পত্রিকা পড়ে। চাকরির বিজ্ঞাপন পড়ে। কিন্তু চাকরির বয়স নির্দিষ্ট। তেত্রিশ বছরের নাফিস তাই নিজের যোগ্যতায় বর্তমানের চেয়ে ভালো কিছুর খোঁজ পায় না।
তোহার ডাকে নাফিস আজ উঠলো। আজ ডাইনিং এ ম্যানেজার এসে সবার সাথে তোহার পরিচয় করিয়ে দেবে। এমনিতে সে কারো ব্যক্তিগত বিষয় জানতে আগ্রহী হয় না। তবে রুমে নতুন কেউ এলে তার সম্পর্কে কিছু জানা থাকাটা ভালো। নিজে প্রশ্ন করে জানার চাইতে যদি এমনিতেই জানা হয়ে যায় সেটা আরো ভালো। নাফিস তাই বিছানা ছাড়তে ছাড়তে বললো, হুমম আসছি। চলেন।
তিন
তোহা একটা টেক্সটাইল কোম্পানিতে নাইট শিফটে কাজ করে। নাইট শিফট শুনে রাতে একা একটা রুমে ঘুমাতে পারবে ভেবে নাফিসের মনে মনে ভালো লাগে! বহু বহু রাত ওর ঘুম হয় না। লাইট জ্বেলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রাত পার করে দেয়। রুমমেট না থাকলে কারো সুবিধা অসুবিধা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না এটা শান্তির বিষয়! ডাইনিং থেকে ফেরার পথে নিজের সম্পর্কে আরো কিছু বলে তোহা। সে বাঁশি বাজাতে জানে। আর সাগর তার ভীষণ প্রিয়। সময় সুযোগ পেলে কিংবা ভীষন মন খারাপ হলে সে সাগর দেখতে চলে যায়। দেয়ালে সাগরের ছবি টানানোর কারণ তবে এইই--ভাবে নাফিস। তোহা প্রচুর কথা বলে। ডাইনিং টা সে একাই কথা বলে সরগরম করে তুলেছিলো। আর জোকস নয় তবু মজার মজার এমন সব কথা বলছিলো যে ডাইনিং এ আসা প্রত্যেকেই হাসিতে ভেঙে পড়ছিলো। নাফিস বুঝে এজন্যই তোহার রুম গোছানোর সময় নাফিসের সাথে কথা বলতে চেয়ে তেমন সাড়া না পেয়ে শিশ বাজাচ্ছিল! তোহার কথাবার্তায় মনে হয় তার কোনো দুঃখ টুঃখ নাই। হাঁটা চলা দেখলে মনে হয় এখনো ছাত্র জীবন তার। নাফিস মনে মনে তোহার সাথে নিজেকে মেলাতে চায়। তোহা কি তার চেয়ে অনেক ছোট? মনে তো হয় না অথচ জীবন চলার চাপে নাফিসের মাঝে মাঝে নিজেকে পঞ্চাশ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী বলে মনে হয়! রুমে ফিরে তোহা নাফিস কে বলে, নাফিস ভাই মন খারাপ হলে সাগরের ছবিটার দিকে তাকাবেন। দেখবেন মন ভালো হয়ে গেছে।
চার
আজ নাফিসের মন খারাপ। ভীষণ মন খারাপ। বাড়ি থেকে বাবা ফোন করেছিলো, মা স্ট্রোক করে হসপিটালে, চিকিৎসার জন্য এক লাখ টাকা প্রয়োজন। ছোট বোনটাকে জামাই ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। বিয়ের সময় জামাইকে দুবাই পাঠানোর কথা ছিলো। টাকার ব্যবস্থা করা হয়নি আর।
অফিস ছুটির পর প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ায় নাফিস। মাথাটা ব্যথায় দপ দপ করছে। বুকের ভেতর তীব্র চাপ। টাকা জোগাড় না হলে মায়ের চিকিৎসা বন্ধ থাকবে। চিকিৎসা না হলে মা মারা যাবে। মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকলেও মা তো পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আছে! মা ছাড়া জীবন কল্পনা করা অসম্ভব! মাথার ভেতর ভীষণ শূন্যতা ঘুরপাক করে। বুকের ভেতর প্রচন্ড যন্ত্রণা যেন তাবৎ পৃথিবীর সমস্ত এসিড ওখানে ঢেলে দিয়েছে কেউ। পরিচিত এমন কেউ নেই যে তাকে লাখ টাকা ধার দেবে। অনেক ভেবেও কাউকে মনে পড়ে না। নিজে বেঁচে থাকতে চিকিৎসার অভাবে মা মরে যাবে এটা ভাবতে পারে না নাফিস। জীবনের সব অপূর্ণতাগুলো মাথায় বাজির মতো ফুটতে থাকে। জীবনটাকে প্রচন্ড রকম, ভীষণ রকম ব্যর্থ বলে মনে হয়। ভীষণ ইচ্ছে হয় নিজের কষ্ট গুলো কাউকে বলে বুকটাকে একটু হাল্কা করে। ইস্ কেউ যদি ভালোবেসে মাথায় একটা হাত রাখতো! নাফিসের হৃদয় এ মুহূর্তে একটা পরম আশ্রয় খোঁজে। যেখানে ও নির্ভার হয়ে ঘুমাবে। এ পৃথিবীতে তা আর পাওয়া হবে না, বুঝে গেছে নাফিস। এ জীবনের কোনো অর্থ সে খুঁজে পায় না। মনে মনে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাত প্রায় এগারোটায় রুমে ফিরে আসে।
পাঁচ
এই শীতের রাতেও ঠান্ডা জল দিয়ে স্নান করে নাফিস। মাথা ব্যথা, চোখ জ্বলছে, বুকে হাহাকার কিন্তু এসব কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। দুশ্চিন্তায় অনুভূতি শক্তি হারিয়ে গেছে যেন। দুচোখে বিশাল শূন্যতা নিয়ে বিছানায় বসতে যেয়ে নাফিসের চোখ পড়ে তোহার টানানো সাগরের ছবিটার দিকে। পাশাপাশি দুটো ছবি জুড়ে একটা বিশাল ছবি করেছে তোহা। সাগরের ছবিটা চোখে পড়তেই নাফিসের তোহার কথা মনে পড়ে। তোহা বলেছে মন খারাপ হলে ঐ ছবিটার দিকে তাকাতে। নাফিস ছবিটার কাছে এগিয়ে যায়। ছবিটা দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাতেই মনে এক অদ্ভূত অনুভূতি হয়। মনে হয় একটা লোনা ঘ্রানযুক্ত বাতাস সাগরের ঢেউ এর শোঁ শোঁ শব্দ নিয়ে রুমের ভেতর বয়ে যাচ্ছে। সে যেন দাঁড়িয়ে আছে বেলাভূমিতে! নাফিস আর একটু এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে ছবিটা ছুঁতেই সাগরের সুনীল জল ছুটে এসে নাফিসের হাত কব্জি পর্যন্ত ভিজিয়ে দিলো! অবাক নাফিস ছবিটার আরো কাছে এগিয়ে যেতেই ও অনুভব করে সাগরের প্রবল ঢেউ একের পর এক বেলাভূমিতে ভাঙতে ভাঙতে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর সমস্ত শরীর। শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়িয়ে একটা মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসে। কণ্ঠটা ভীষণ চেনা মনে হয়। ..হ্যাঁ এটা মোনার কণ্ঠ। মোনা ওকে ডাকছে, নাফিস---তাড়াতাড়ি এসো। তাড়াতাড়ি--আমি তোমায় নিয়ে সাগরের আরো গভীরে চলে যেতে চাই। পৃথিবীর কোনো কষ্ট যেন আর তোমায় ছুঁতে না পারে----