বন্দুকের গুলি আর পাচার করা টাকা ফিরে আসে না!
পলাশ মাহবুব। আমার খুবই পছন্দের একজন। পলাশ একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। সৃষ্টিশীল মানুষ মানেই আমার কাছে বিস্ময়, তারা নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে বিশেষ কিছু নিয়ে এসেছেন।
পলাশের অনেক পরিচয়। মূলত সাংবাদিক। কিন্তু ছড়া লেখেন, নাটক লেখেন, গণসংযোগ করেন। তার কাজের পরিধি বিশাল। তবে ফেসবুকে তার ছোট ছোট স্ট্যাটাসগুলো আমার সবচেয়ে প্রিয়।
স্ট্যাটাসে তার তীক্ষ্ণ রসবোধের যে পরিচয় পাই, তা অনন্য। আমরা সবাই সব বিষয়ে সিরিয়াস। যেকোনো ইস্যু পেলেই আমরা পক্ষে-বিপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ফান আমরা নিতেই পারি না। কেউ ফান করলেও আমরা সিরিয়াস হয়ে যাই। তবে পলাশ সিরিয়াস বিষয়ে কথা বলেন হালকা চালে।
কলকাতায় পি কে হালদার গ্রেপ্তারের পর এ নিয়ে তোলপাড় দুই দেশেই। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুট করে পালিয়ে যাওয়া পি কে হালদারকে নিয়ে অনেকেই নানারকম স্ট্যাটাস দিয়েছেন। পলাশ মাহবুবেরটা আমার মনে ধরেছে, ‘মুখের কথা, বন্দুকের গুলি আর পাচার করা টাকা- একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরত আসে না।’ দেখুন পলাশ কেমন অবলীলায় একটি তিক্ত সত্য বলে ফেলল। এ যেন বিন্দুতে সিন্ধু ধারণ।
এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে একটি পি কে হালদারের গ্রেপ্তারে দুই দেশের সমস্যাগুলো দেখে আসি। চারটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে কয়েক হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া পি কে হালদারকে নিয়ে বাংলাদেশে যে তোলপাড় হবে সেটা তো স্বাভাবিক। সবাই এখন অপেক্ষা করছেন, কবে পি কে ফিরবেন এবং তার গডফাদারদের নাম বলবেন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, কারা বিদেশে টাকা পাচার করে জানব কীভাবে? তিনি পাচারকারীদের তালিকা দিতে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। যে দেশের অর্থমন্ত্রী এতটা ইনোসেন্ট, সেই দেশ থেকে যে অবাধে টাকা পাচার করা সম্ভব, সেটা তো পানির মতো পরিষ্কার।
পি কে হালদারকে কবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, সেটা অনিশ্চিত। আর ফিরে আসলেই যে তিনি গডফাদারদের নাম বলতে পারবেন আর বললেই যে সেটা আমজনতা জানতে পারবে; তার কোনো গ্যারান্টি নেই। সরকার যদি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেও, তাকে নিশ্চয়ই গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
পি কে হালদারের গডফাদারের নাম আমরা জানতে পারি আর না পারি, এটা নিশ্চিত, তারাও উচ্চ ক্ষমতাশালী কেউ। কারণ পি কে হালদার তো আর এক ক্লিকে কয়েক হাজার কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেননি। ৫/৬ বছর ধরে করেছেন। নিশ্চয়ই উচ্চ ক্ষমতাশালী কেউ তাকে সহায়তা করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ দুই সাবেক কর্মকর্তার নাম এলেও তাদের এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। ভারত পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করতে পারলে বাংলাদেশ কেন এস কে সুর চৌধুরী আর শাহ আলমকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না?
পি কে হালদারের হাত যে অনেক লম্বা, সেটা বোঝার জন্য একটা ছোট্ট তথ্যই যথেষ্ট- ২০১৯ সালে পি কে হালদারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় উচ্চ আদালত। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর ২ ঘণ্টা ৯ মিনিট আগে পি কে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কী বুঝলেন?
পি কে হালদারকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে ভারতও। তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ঘুঁটি। পি কে হালদার এবং তার সঙ্গীরা কীভাবে সেখানে সম্পদের পাহাড় গড়ল, কীভাবে রেশন কার্ড-আধার কার্ড-পাসপোর্ট পেল? এইসব প্রশ্নে এখন তোলপাড় পশ্চিমবঙ্গ। ব্যাপারগুলো যদি এতই সহজ হয়, তাহলে মানতেই হবে ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় রকমের ত্রুটি আছে। তাই ভারতের অপরাধের নিষ্পত্তি হওয়ার আগে পি কে হালদারকে বাংলাদেশের পাওয়ার চান্স কম।
এবার আসি পলাশ মাহবুবের স্ট্যাটাস প্রসঙ্গে। অনেকে বলছেন, পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনার দরকার নেই। তার পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনলেই হবে। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে আগে আর পরে পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনা হয়তো সম্ভব। কিন্তু পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে আমি পলাশ মাহবুবের সাথে একমত।
আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা কিছু টাকা ফিরিয়ে আনাই হলো পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার একমাত্র উদাহরণ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটি-জিএফআই’র প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে গতবছর বিভিন্ন পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছিল, গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছিল। কোকোর টাকা বাদ দিলে যার কোনোটাই আর ফিরে আসেনি।
অর্থমন্ত্রী চাইলে পাচারকারীদের নাম জানতে পারবেন। সম্ভব পাচার করা টাকার সন্ধান পাওয়াও। কিন্তু নাম জানলেও পাচারকারী বা পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা অনেক জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
প্রথম কথা হলো, সরকার পাচারের এই মহোৎসবের কথা স্বীকারই করেনি, ফিরিয়ে আনা তো অনেক পরের কথা। ২০২১ সালে সংসদে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে বিরোধী দলের দাবির মুখে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, কারা বিদেশে টাকা পাচার করে জানব কীভাবে? তিনি পাচারকারীদের তালিকা দিতে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। যে দেশের অর্থমন্ত্রী এতটা ইনোসেন্ট, সেই দেশ থেকে যে অবাধে টাকা পাচার করা সম্ভব, সেটা তো পানির মতো পরিষ্কার।
বাংলাদেশ থেকে কীভাবে টাকা পাচার হয়? নিশ্চয়ই লাগেজে ভরে টাকা নিয়ে যাওয়া হয় না। তাহলে পি কে হালদারকে ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করতে তো বিমান ভাড়া করতে হতো। টাকা আসলে এভাবে পাচার হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়।
আমদানি-রপ্তানিতে ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং, হুন্ডি বা ব্যাংকিং চ্যানেলেই টাকা পাচার হয়। তাই আর্থিক গোয়েন্দারা যদি এইসব ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি করেন, তাহলে পাচার অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। আর মালয়েশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বাংলাদেশের কারা হঠাৎ বাড়ি-গাড়ি করছে; কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ করলে; তা বের করাও অসম্ভব নয়।
অর্থমন্ত্রী চাইলে পাচারকারীদের নাম জানতে পারবেন। সম্ভব পাচার করা টাকার সন্ধান পাওয়াও। কিন্তু নাম জানলেও পাচারকারী বা পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা অনেক জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
টাকা যেই দেশে পাচার হয়, সেই দেশের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলেই কেবল টাকা ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন। তাই টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টার পাশাপাশি আর একটি টাকাও যাতে পাচার হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
নিচে ছিদ্র থাকলে আপনি কখনোই ট্রাঙ্ক ভর্তি করতে পারবেন না। তাই আমরা যতই উন্নয়নের গল্প করি না কেন, এই দুর্বৃত্তদের আটকাতে না পারলে অর্থনীতি কখনোই পূর্ণতা পাবে না।
আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রেমিট্যান্স পাঠাবে আর কিছু লুটেরা সেই টাকা বিদেশে পাচার করবে, এটা চলতে দেওয়া যায় না।